‘ডেঙ্গুর শহর’ ঢাকা, জ্বর হলেই ছুট হাসপাতালে
# ঢাকা এখন ডেঙ্গুর শহর
# প্যারাসিটামলজাতীয় ট্যাবলেটে মূল ভরসা রোগীদের
# স্থানীয় ফার্মেসিতে নাপা-প্যারাসিটামল বিক্রির ধুম
# ভয়ে হাসপাতালে যাচ্ছেন না অনেকে
# ডেঙ্গু নিয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
দেশে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর তালিকা। রাজধানী ঢাকার কিছু এলাকায় এসিড মশাবাহিত এ ভাইরাসটির সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। হাসপাতালে বাড়ছে ডেঙ্গুরোগীর চাপ। বিশেষত, ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডগুলো এখন রোগীতে ঠাসা। অনেক রোগী শয্যা পাচ্ছেন না। রোগী ও তাদের সঙ্গে থাকা স্বজনদের চাপে হাসপাতালের বারান্দায়ও পা ফেলার জায়গা নেই।
জ্বর হলেই ডেঙ্গু- বিষয়টি এমন নয়। তবে ভীতি ও সতর্কতার জায়গা থেকে এখন জ্বর হলেই অনেকে হাসপাতালে ছুটছেন ডেঙ্গুর নমুনা পরীক্ষার জন্য। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু লক্ষণ দেখা যায়। এরমধ্যে উচ্চ জ্বর, মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, ক্লান্তি, জয়েন্টে ব্যথা, ত্বকে ফুসকুড়ি ও বমি ভাব অন্যতম। কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে এসব লক্ষণ না-ও থাকতে পারে। চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু হলে সময়মতো সঠিক চিকিৎসা নিতে হবে। অন্যথায় রোগীর জন্য বিপদের শঙ্কা থাকে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, অনেকে যেমন জ্বর হলেই হাসপাতালে ছুটছেন, অনেকে আবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েও হাসপাতালে যাচ্ছেন না। তারা হাসপাতালের পরিবর্তে বাসায় থেকে ঘরোয়াভাবে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ ধরনের রোগীর সংখ্যাও এখন বাড়ছে। তবে ঘরোয়া চিকিৎসায় রোগীদের মূল ভরসা ‘প্যারাসিটামলজাতীয় বড়ি।’
আরও পড়ুন: ডেঙ্গুতে সিনিয়র সহকারী সচিবের মৃত্যু, ছিলেন ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা
রাজধানীর বাসাবো এলাকার হামিদুল ইসলাম সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক। গত কদিন ধরেই জ্বরে ভুগছিলেন। প্রথম দুদিন যেতে না যেতেই তার জ্বরের মাত্রা বাড়তে থাকে। শরীর প্রচণ্ড ব্যথা ও বমি ভাব হয়। শরীর এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে ভয় পেয়ে যান হামিদুল। এ অবস্থায় তিনি শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনিতে বড় বোনের বাসায় আশ্রয় নেন।
বাসায় থেকেই একটি বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গুর নমুনা পরীক্ষা করান হামিদুল। রিপোর্টে তার ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। সরকারি হাসপাতালে রোগীর চাপ আর মুত্যুর কথা ভেবে ভয় পেয়ে যান তিনি। পরে স্থানীয় একটি ফার্মেসিতে শুরু হয় তার ডেঙ্গু চিকিৎসা।
হামিদুল জাগো নিউজকে বলেন, আমার জ্বরের মাত্রা বেশি ছিল, প্লাটিলেট কত ছিল জানি না। সরকারি হাসপাতালে প্রতিদিনই মানুষ মারা যাচ্ছে, এ কারণে আমি বাসায় থেকে জ্বরের জন্য প্যারাসিটামলজাতীয় ওষুধ আর শরবত খেয়েছি। এখন বেশ ভালো বোধ করছি।
আরও পড়ুন: ডেঙ্গু এখনো নিয়ন্ত্রণে: স্বাস্থ্যমন্ত্রী
কথা হয় খিলগাঁও এলাকার মারুফ হাসানের সঙ্গে। গত ২০ জুলাই থেকে স্ত্রীসহ তিনি জ্বরে ভুগছিলেন। শুরুতে স্থানীয় ফার্মেসি থেকে অ্যান্টিবায়োটিক ও প্যারাসিটামলজাতীয় ট্যাবলেট খেয়েছেন। তাতে জ্বর না কমায় এ দম্পতি ডেঙ্গুর নমুনা পরীক্ষা করান, সেখানে দুজনেরই ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। মারুফ জাগো নিউজকে বলেন, আমরা কোনো টেনশন নিইনি, নাপা ট্যাবলেট খেয়েছি। সঙ্গে ডাব-স্যালাইন-লেবুর শরবত চলছিল। এখন জ্বর কমেছে, শরীর আগের চেয়ে ভালো বোধ করছি। তবু আরেকবার পরীক্ষা করতে দিয়েছি।
সবুজবাগ এলাকার আয়েশা খাতুনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, শরীরে প্রচুর জ্বর ছিল, শরীর দুর্বল ছিল। দুর্বলতা কাটাতে স্থানীয় ফার্মেসিতে স্যালাইন নিতে গিয়েছিলাম, কিন্তু কোথাও পেলাম না। পরে নাপা ট্যাবলেট খেয়েছি। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হাসপাতালে না যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাসপাতালে গেলে আরও অসুস্থ হয়ে পড়বো। সেখানে অনেকেই ডেঙ্গুতে মারা যাচ্ছেন। এসব দেখতে ভালো লাগে না। এ ভয়েই বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় বাড়তি সতর্কতার অংশ হিসেবে অনেকে বাসায় খাবার স্যালাইন ও প্যারাসিটামলৎজাতীয় ওষুধ কিনে রাখছেন। মুগদা, বাসাবো, সবুজবাজ ও খিলগাঁও এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার ফার্মেসিগুলোতে প্যারাসিটামলজাতীয় ওষুধের চাহিদা বেড়েছে। তবে এখন পর্যন্ত সরবরাহ স্বাভাবিক থাকায় এসব ওষুধের দাম যেমন বাড়েনি, বাজারে ওষুধের সংকটও তৈরি হয়নি।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশে ‘মহামারির’ পর্যায়ে ডেঙ্গু, বলছেন বিশেষজ্ঞরা
এ নিয়ে কথা হয় খিলগাঁও এলাকার সততা ফার্মেসির মালিক রিপনের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এখন বেশিরভাগ মানুষই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ওষুধ কিনতে আসছেন। স্বাভাবিক জ্বর হলে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি। জ্বর বেশি বা না কমলে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলছি।
তিনি বলেন, গত কয়েক মাসের মধ্যে নাপা আর প্যারাসিটামল ট্যাবলেটের চাহিদা এখন দ্বিগুণ। অনেকেই জ্বর নিয়ে এসব ওষুধ কিনতে আসছেন। অনেকে জ্বর না কমলেও বাসায় থেকে নিজেদের মতো করে চিকিৎসা নিচ্ছেন। অন্য অনেক ফার্মেসির বিক্রয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেও প্রায় একই তথ্য জানা যায়।
এদিকে ডেঙ্গু নিয়ে এরই মধ্যে সতর্কবার্তা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সংস্থাটি বলছে, চলতি বছর বিশ্বে ডেঙ্গু জ্বরে রেকর্ডসংখ্যক রোগী আক্রান্ত হতে পারে। এজন্য অংশত দায়ী বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, যা মশার বংশবিস্তারের সহায়ক পরিবেশ তৈরি করছে। ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, ডেঙ্গুর প্রকোপ পৃথিবীজুড়েই বাড়ছে। ২০০০ সালে যত মানুষ মশাবাহিত এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল, ২০২২ সালে সে সংখ্যা আটগুণ বেড়ে ৪২ লাখে উন্নীত হয়েছে। চলতি বছর মার্চে সুদানের রাজধানী খার্তুমে প্রথমবারের মতো ডেঙ্গুরোগী শনাক্ত হয়।
আরও পড়ুন: ঢাকার যে ১১ এলাকা থেকে ডেঙ্গুরোগী বেশি আসছেন
গত ২১ জুলাই সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ রমন বিলাওধোন সাংবাদিকদের জানান, বর্তমানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষ ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে। ২০১৯ সালে বিশ্বে রেকর্ড সংখ্যক ডেঙ্গুরোগী শনাক্ত হয়। তখন ১২৯টি দেশে প্রায় ৫২ লাখ মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত বিশ্বে ৪০ লাখ মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত। এরমধ্যে লাতিন আমেরিকায়ই শনাক্ত প্রায় ৩০ লাখ রোগী। আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, প্যারাগুয়ে ও পেরুর মতো দেশগুলো ডেঙ্গুর উচ্চঝুঁকিতে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৫ হাজার ২৭০ জন। তাদের মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ২১ হাজার ১৮৭ জন আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন ১৪ হাজার ৮৩ জন। একই সময়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ২৭ হাজার ৬২২ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ১৬ হাজার ৬৪৪ এবং ঢাকার বাইরের ১০ হাজার ৯৭৮ জন। চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত ১৮৫ জন মারা গেছেন। ২৪ জুলাই পর্যন্ত ঢাকাসহ সারাদেশে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা ৭ হাজার ৪৬৩ জন।
আরও পড়ুন: ডেঙ্গু নিয়ে সতর্ক করলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
ইএআর/এমকেআর/জেআইএম