ডিএনসিসি ডেঙ্গু হাসপাতাল
পরিবেশ-চিকিৎসায় সন্তোষ, ঘাটতি জনবলের
# ৫০০ শয্যা রাখা হয়েছে ডেঙ্গুরোগীদের জন্য
# দুটি আইসিইউ ইউনিটে ৫০ শয্যা চালু
# ঘাটতি রয়েছে জনবলের
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন মেহেদী হাসান। স্ত্রী ও দুই বছরের মেয়েকে নিয়ে ভাড়া থাকেন কারখানার পাশেই একটি টিনশেড ঘরে। সাতদিন আগে জ্বর আসে মেহেদীর। পরীক্ষার পর শনাক্ত হয় ডেঙ্গু। এরপর তিনি ভর্তি হন নারায়ণগঞ্জের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। তবে সেখানে চিকিৎসা খরচ বেশি হওয়ায় পরদিন চলে যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। কিন্তু এ হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে শয্যা খালি নেই। ফলে ভর্তি নেয়নি কর্তৃপক্ষ। পরে মেহেদী যান মহাখালীর ডিএনসিসি হাসপাতালে। সেখানে ভর্তি হয়ে ছয়দিন ধরে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি।
সোমবার (২৪ জুলাই) দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, ডিএনসিসি হাসপাতালের পঞ্চম তলায় একটি কক্ষে মশারি টানিয়ে বসে আছেন মেহেদী। সঙ্গে তার স্ত্রী-সন্তান। এছাড়া তিনি যে কক্ষে চিকিৎসা নিচ্ছেন, সেখানে পৃথক আরও ১০টি শয্যায় রোগী ভর্তি।
ডিএনসিসি হাসপাতালে বাড়ছে ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা
আরও পড়ুন: বাংলাদেশে ‘মহামারির’ পর্যায়ে ডেঙ্গু, বলছেন বিশেষজ্ঞরা
আলাপকালে মেহেদী হাসান জাগো নিউজকে বলেন, নারায়ণগঞ্জের যে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম, সেখানে ডেঙ্গু চিকিৎসার খরচ অনেক বেশি। বাধ্য হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে যাই। গিয়ে দেখি এ হাসপাতালের একটি শয্যাও খালি নেই। ডেঙ্গুরোগী মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পরে ওই হাসপাতালের সংশ্লিষ্টদের পরামর্শে ডিএনসিসি হাসপাতালে যাই।
তিনি বলেন, ডিএনসিসি হাসপাতালে ভর্তির পর থেকে এখন পর্যন্ত ভালোই চিকিৎসা পাচ্ছি। এক ঘণ্টা পরপর ডাক্তার ও নার্সরা ঘুরে ঘুরে খোঁজখবর নিচ্ছেন। তবে রক্তে প্লাটিলেট ওঠানামা করছে। হাসপাতালের বাইরে থেকে কিছু ওষুধও কিনতে হচ্ছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রকৌশল বিভাগের অধীনে চুক্তিভিত্তিক চাকরি করেন মো. কিবরিয়া। পরিবার নিয়ে থাকেন রাজধানীর শনির আখড়ার জিয়া সরণি রোডে। চারদিন ধরে তিনিও ডেঙ্গু চিকিৎসা নিচ্ছেন মহাখালীর ডিএনসিসি হাসপাতালে।
আরও পড়ুন: ডেঙ্গু নিয়ে সতর্ক করলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
আলাপকালে কিবরিয়া বলেন, এখন শনির আখড়া ও আশপাশের এলাকায় ডেঙ্গুর চিত্র ভয়াবহ। সব বাসাবাড়িতেই ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। চিকিৎসার জন্য মানুষ ছোটাছুটি করছে।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর প্রথমে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাই। কিন্তু সেখানে একটি শয্যাও খালি নেই। ডেঙ্গুরোগীদের এক প্রকার ফেরত দেওয়া হচ্ছে। পরে চলে যাই ডিএনসিসি হাসপাতালে। এখানে চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং হাসপাতালের পরিবেশ খুবই ভালো।
ডিএনসিসির এই হাসপাতালটি মূলত একটি বিপণিবিতান। যার আয়তন এক লাখ ৮০ হাজার ৫৬০ বর্গফুট। রাজধানীর মহাখালী বাসস্ট্যান্ডের উত্তর পাশে সাত দশমিক ১৭ একর জমিতে এটি নির্মাণ করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। তবে ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় এ ভবনকে ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতাল ঘোষণা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এখানে মোট এক হাজার ৫৪টি শয্যা রয়েছে। হাসপাতালটিতে আইসিইউ শয্যা ২১২টি। করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় তখন এটি ছিল দেশের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল।
জনবলের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসা সেবায় ‘সন্তুষ্ট’ ডেঙ্গুরোগীরা
আরও পড়ুন: শিশুর ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ কী কী ও কখন হাসপাতালে নেবেন?
তবে ২০২২ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়লে হাসপাতালটি ডেঙ্গুরোগীর চিকিৎসার জন্য খুলে দেওয়া হয়। এবারও ডেঙ্গু চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে এটি। ১৩ জুলাই এই হাসপাতালকে ডেঙ্গুর জন্য ডেডিকেটেড ঘোষণা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে হাসপাতালটির একাংশে এখনো করোনা রোগীদের চিকিৎসা ও টিকা প্রদান কার্যক্রম চলছে।
ডিএনসিসি হাসপাতাল সূত্র জানায়, কয়েক দিন ধরে এ হাসপাতালে ডেঙ্গুরোগী ভর্তির সংখ্যা বেড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় (২৩ জুলাই সকাল ৮টা থেকে ২৪ জুলাই সকাল ৮টা) ৭৭ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। আর সুস্থ হয়ে বাসায় গেছেন ৬২ জন। একজন রোগী আইসিইউতে মারা গেছেন। তবে এখন আরও ১৯ জন রোগী আইসিউতে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
সোমবার (২৪ জুলাই) সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছেন ডেঙ্গুরোগীরা। যাদের আগে ডেঙ্গু পরীক্ষা করা আছে, তাদের সরাসরি ভর্তি নেওয়া হচ্ছে। নার্সরা রোগীদের ট্রলিতে করে শয্যায় নিয়ে যাচ্ছেন। যাদের পরীক্ষা করা নেই, তারা জরুরি বিভাগে ডাক্তার দেখিয়ে পরীক্ষার নমুনা দিচ্ছেন। তারপর হাসপাতালে ভর্তি রাখা হচ্ছে। তবে আয়তনের তুলনায় হাসপাতালটি ফাঁকা লাগছে। এছাড়া ছয়তলা হাসপাতালের অধিকাংশ শয্যা ফাঁকা দেখা গেছে।
আরও পড়ুন: ডেঙ্গু সারাতে পেঁপে পাতা যেভাবে কাজ করে
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএনসিসি হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, এখন পর্যন্ত এই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের ৯০ শতাংশ ঢাকার। সবচেয়ে বেশি রোগী আসছে যাত্রাবাড়ী, মুগদা, কদমতলী, জুরাইন, মানিকনগর, সবুজবাগ, উত্তরা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, তেজগাঁও ও বাড্ডা থেকে।
ডিএনসিসি হাসপাতালে চিকিৎসার বিষয়ে এক রোগীর কাছে জানতে চাওয়া হয়। তার নাম ইকবাল হাসান। তিনি মিরপুর-১১ নম্বরের বাসিন্দা। সোমবার (২৪ জুলাই) ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে এ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
ইকবাল হাসান বলেন, গত ২২ জুলাই থেকে তার জ্বর। পরদিন পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়ে। দেরি না করে ডিএনসিসি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য চলে যাই। এখানে চিকিৎসা সেবা খুবই ভালো। তবে কিছু ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে।
ডিএনসিসি হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক কর্নেল একেএম জহিরুল হোসাইন খান জাগো নিউজকে বলেন, এই হাসপাতালে পর্যাপ্ত শয্যা প্রস্তুত। তবে ঘাটতি আছে কিছু জনবলের। যে ঘাটতি পূরণের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কাজ করছে। তারা হয়তো দু-একদিনের মধ্যে জনবল পূরণ করতে পারবে। এছাড়া আমাদের ল্যাবে পরীক্ষায় কিছু সমস্যা হয়েছিল। এখন সে সমস্যা নেই। রোগীদের পরীক্ষার রিপোর্ট পেতে আর বিলম্ব হবে না।
আরও পড়ুন: সাধারণ জ্বর নাকি ডেঙ্গু বুঝবেন যেসব লক্ষণে
ডিএনসিসি হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক কর্নেল একেএম জহিরুল হোসাইন খান
তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার সব প্রস্তুতি আছে। আমরা আশা করি করোনার মতো ডেঙ্গু চিকিৎসা ডেডিকেটেডভাবে দিতে পারবো। এই মুহূর্তে ৫০০ শয্যা রাখা হয়েছে ডেঙ্গুরোগীদের জন্য। পরে এটা ৮০০ শয্যা পর্যন্ত করা হবে। ভেন্টিলেটর সাপোর্টসহ আইসিইউগুলো প্রয়োজনে আমরা ডেঙ্গুরোগীর আইসিউতে শিফট করবো। এখন আমাদের দুটি আইসিইউ ইউনিট (৫০ শয্যা) চালু আছে, প্রয়োজনে আরও বাড়ানো হবে।
ডিএনসিসি হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসা সেবা আরও উন্নত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা হয়েছে বলে জাগো নিউজকে জানান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম।
তিনি বলেন, করোনা মহামারির সময় ডিএনসিসি হাসপাতাল চিকিৎসা সেবায় বড় ভূমিকা রেখেছে। এখন ডেঙ্গুরোগীদের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের বলা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, তারা জনবলের ঘাটতি কমাতে কাজ করছে। এছাড়া পর্যাপ্ত ওষুধ হাসপাতালে সরবরাহের ব্যবস্থা করবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এমএমএ/জেডএইচ/জিকেএস