বাড্ডায় ঘরে ঘরে ডেঙ্গুরোগী, নিম্নবিত্তের ভরসা নাপা
#টিনশেড ঘরে ডেঙ্গুরোগীর ছড়াছড়ি
#গলিতে গলিতে নির্মাণাধীন ভবনে ডেঙ্গুর ‘আবাদ’
#মশা নিধনে ‘দায়সারা’ তৎপরতার অভিযোগ
নিচে সারি সারি রিকশা। ওপরে কাঠের পাটাতন বসিয়ে শোয়ার জায়গা। ঘুটঘুটে অন্ধকার। একদিকে টিম টিম করে জ্বলছে ছোট্ট একটি এলইডি বাল্ব। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই দেখা গেলো মশারি টাঙিয়ে শুয়ে আছেন কয়েকজন। কেউ মশারি ছাড়াই। সবার জ্বর, শরীরে ব্যথা। তারা সবাই রিকশাচালক। জ্বরে আক্রান্তদের মধ্যে দুজন টেস্ট করিয়েছেন। দুজনই ডেঙ্গু পজিটিভ। তারাও থাকছেন সেখানেই। হাসপাতালে ভর্তির টাকা নেই। গ্যারেজে শুয়েই জ্বরের ওষুধ (নাপা ট্যাবলেট) খেয়ে ডেঙ্গু কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় তারা।
রাজধানীর মধ্যবাড্ডার আদর্শনগর ৩ নম্বর রোডের ফারুক গ্যারেজের চিত্র এটি। এ গ্যারেজে ৩৫ জন রিকশাচালক অস্থায়ীভাবে বসবাস করেন। সারাদিন রিকশা চালান, রাতে গ্যারেজে থাকেন। গ্যারেজের পরিবেশ মাত্রা ছাড়ানো নোংরা। চারদিকে ওড়াওড়ি করছে মশা-মাছি। মালিকপক্ষের কোনো খোঁজ নেই।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়েছে এ এলাকা। গ্যারেজ ও আশপাশের বাসিন্দাদের অভিযোগ, তাদের এলাকায় গত তিন-চার মাসে একবারও তারা সিটি করপোরেশনের মশক নিধন অভিযান দেখেননি। চারপাশে জ্বরে আক্রান্ত মানুষ। টেস্ট করালেই ডেঙ্গু পজিটিভ আসছে। তবে অধিকাংশ জ্বরে আক্রান্ত মানুষই টেস্ট করানো থেকে বিরত থাকছেন।
আরও পড়ুন>> ডেঙ্গুর চিকিৎসা খরচ জোগাতে নাভিশ্বাস নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারে
‘ফারুক গ্যারেজ’র রিকশাচালক মো. রাজু জাগো নিউজকে বলেন, ‘খুব মশা। এদিকে ওষুধ বা ধোঁয়া দিতে কাউরে আসতে তো দেহি না। নিজেরা যতটুকু পারছি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকছি। এদিকে অনেক অসুস্থ রোগী। আমাদের গ্যারেজে অনেকে অসুস্থ। জ্বর নিয়েই অনেকে রিকশা চালাচ্ছেন।’
৩ নম্বর রোড ধরে কিছুদূর এগিয়ে যেতেই চায়ের দোকানে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় করম আলী নামে এক বৃদ্ধের। তার বাড়ি মাদারীপুরের শিবচর। করম আলীর ছোট মেয়ে রোকসানা আক্তার ডেঙ্গু আক্রান্ত। রোকসানা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত।
করম আলী বলেন, ‘মেয়ের ডেঙ্গু, খুব অসুস্থ। এখানে ভাড়া বাসায় থাকে (বাড্ডা ময়নারবাগের মন্ত্রীমাঠ)। ইবনে সিনায় টেস্ট করিয়েছি। টেস্টে ডেঙ্গু ধরা পড়েছে। বাসায় থেকে ডাব, গ্লুকোজ আর কিছু ওষুধ খাচ্ছিল। গতকাল (সোমবার, ২৪ জুলাই) রাত থেকে পাতলা পায়খানা শুরু হয়েছে। কয়েকবার বমিও করেছে। কোন হাসপাতালে ভর্তি করবো সেটাই এখানকার লোকজনের কাছে জিজ্ঞাসা করছিলাম। আমি তো এদিকের কিছুই চিনি না। আশপাশের হাসপাতালে কোনো বেড ফাঁকা নেই। এখন মহাখালীর দিকে নেবো। সিএনজি অটোরিকশা আনতে গেলো বড় ছেলে।’
আল-আকসা মসজিদ রোডের টিনশেড একটি বাসায় থাকেন খাদিজা আক্তার। এক সপ্তাহ ধরে জ্বর। শনিবার (২২ জুলাই) এ এম জেড হাসপাতালে টেস্ট করিয়েছেন। ডেঙ্গু পজিটিভ। খাদিজা যে ঘরে শুয়ে আছেন, তার পরিবেশ স্যাঁতস্যাঁতে। মশারিও টাঙাননি। অথচ তার ওই টিনশেড বাড়িতে আরও ১৫টি ঘর। যেখানে আলাদা আলাদা পরিবার বসবাস করছে। ২০-২২ জন শিশু থাকে ওই বাড়িতে।
খাদিজা আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, ‘শরীরটা নড়াতে পারছি না। প্রচণ্ড ব্যথা। গতকাল রাতে বমি করেছি। পেটেও সমস্যা হচ্ছে। আমার স্বামী ফুটপাতে বিভিন্ন জিনিস বেচাকেনা করে। আমরা গরিব মানুষ। অত টাকা কই পাবো? নাপা বড়ি খাচ্ছি। কাল একটা ডাব খাইছি। একটা ডাবের দাম ১২০ টাকা। আমাদের চিকিৎসা করানোর উপায় নেই। আল্লাহ বাঁচালে বাঁচবো, না হলে যা হওয়ার হবে।’
আরও পড়ুন>> ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রম সারাবছর চালাতে হবে: স্বাস্থ্যের ডিজি
মধ্যবাড্ডার আদর্শনগর, বাজার রোড, কবরস্থান রোড, মন্ত্রীমাঠ, ময়নারবাগ, পোস্ট অফিস মোড়, উত্তর বাড্ডার সাঁতারকুল, নুরেরচালা, দক্ষিণ বাড্ডার বৈশাখী সরণিসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘরে ঘরে জ্বরে আক্রান্ত মানুষ। মধ্যবাড্ডা ও উত্তর বাড্ডায় নিম্নবিত্ত মানুষের বসবাস বেশি। এখানকার টিনশেড ঘর, গোসলখানা, টয়লেট যেন ডেঙ্গুর প্রজননকেন্দ্র।
গলিতে গলিতে নির্মাণাধীন ভবন
মধ্যবাড্ডা, উত্তর বাড্ডার গলিতে গলিতে চোখে পড়বে নির্মাণাধীন ভবন। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে কাজ শুরু করে বৃষ্টির মৌসুম হওয়ায় এখন অধিকাংশ ভবনে কাজ বন্ধ। নির্মাণাধীন এসব ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে পানি-কাদা ও নোংরা পরিবেশ। যেখানে ডেঙ্গুর নিরাপদ আবাস।
চৌদ্দসরণি এলাকায় ছয়মাস ধরে একটি ভবনের কাজ চলছে। ভবনের মালিক কে তা কেউ জানাতে পারেননি। যিনি কাজ দেখভাল করেন, তিনিও গত একমাস ভবনে আসেননি। কাজ বন্ধ হয়ে পড়ে আছে তিনমাসের বেশি সময়। ওই ভবনের বেজমেন্টে পানি জমে আছে। তার মধ্যে আবর্জনা ফেলায় তা পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ওড়াওড়ি করছে মশা।
ভবনের পাশে একটি টিনশেড বাড়ি। সেখানে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন ইদ্রিস আলী। তিনি বলেন, ‘আমাদের এদিকে বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিল। তবে এ বিল্ডিংটা এভাবে ফেলা রাখায় এর ভেতরে ময়লা-আবর্জনা জমছে। এখানে প্রচুর মশা। বিকেলে ভবনের আশপাশে দাঁড়ানো যায় না। এখানে কোনো অভিযান বা মশার ওষুধ দিতেও দেখিনি।’
শুধু চৌদ্দসরণি নয়, পোস্ট অফিস রোড, কবরস্থান রোড, আল-আকসা মসজিদ রোড, মেরুল বাড্ডা, ময়নারবাগ, মন্ত্রীর মাঠসহ পুরো এলাকায়ই শত শত নির্মাণাধীন ভবন পড়ে আছে। তবে এসব ভবনে সিটি করপোরেশনের অভিযান হতে দেখেননি এলাকাবাসী।
৩৭ নম্বরে তৎপর, ৩৮-এ ‘গুরুত্ব নেই’
বাড্ডা এলাকা দুটি ওয়ার্ডের মধ্যে পড়েছে। মধ্যবাড্ডা বাজার রোড থেকে দক্ষিণ দিকের অংশ পড়েছে ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে। আফতাবনগর, পোস্ট অফিস রোড, কবরস্থান রোড, মেরুল বাড্ডা এ ওয়ার্ডের অন্তর্গত। এ ওয়ার্ডে তিন লাখের বেশি মানুষের বসবাস। এখানকার বাসিন্দারা অধিকাংশই ভাড়াটিয়া এবং নিম্নবিত্ত। বাসিন্দারা জানান, বহুদিন পর গত সপ্তাহে একবার মশা নিধনে স্প্রে করতে দেখেছেন তারা। তবে ঠিকঠাক মতো গলিতে ঢুকে স্প্রে করা হয় না। মূল রাস্তার দুপাশে স্প্রে করে দায় এড়ান মশক নিধন কর্মীরা।
৩৭ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডে ডেঙ্গুরোগী এখনো কম। সকাল-বিকেল পুরো এলাকায় কয়েকটা টিম ওষুধ স্প্রের কাজ করছে। তবে এলাকার যারা বাসিন্দা, তারা সচেতন না হলে ডেঙ্গুর প্রকোপ ঠেকানো সম্ভব নয়। এজন্য আমরা ওষুধ ছিটানোর পাশাপাশি হ্যান্ড মাইকে এলাকার মানুষকে সচেতন করছি। সবাই সচেতন হলেই কেবল ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব।’
আরও পড়ুন>> জ্বর হওয়ার কতদিনের মধ্যে কোন টেস্ট করলে ডেঙ্গু ধরা পড়ে?
৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের পরিস্থিতি এখানো তুলনামূলক ভালো থাকলেও পাশের ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডর অবস্থা বেগতিক। এ ওয়ার্ডের মাধ্যবাড্ডা ময়নারবাগ, আল-আকসা মসজিদ রোড, আদর্শনগর, এগারো-সরণি, মন্ত্রীর মাঠ, উত্তরবাড্ডা বালিপাড়া, উত্তরবাড্ডা পূর্বপাড়া অংশ-২, উত্তরবাড্ডা পূর্বপাড়া (আবদুল্লাহবাগ), উত্তরবাড্ডা মিশ্রিটোলা, উত্তরবাড্ডা হাজীপাড়া এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, গত একমাসেও তাদের এলাকায় মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের কেউ ওষুধ ছিটাতে বা ধোঁয়া দিতে আসেনি। এ ওয়ার্ডটি ঢাকা-১১ সংসদীয় আসন ও ডিএনসিসির (সাঁতারকুল অঞ্চল-১০) আঞ্চলিক কার্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত। এ ওয়ার্ডে প্রায় চার লাখ মানুষের বসবাস।
আদর্শনগর ৩ নম্বর রোডের বাসিন্দা রহিমা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘কই, ছয়মাসেও তো কিছু দেহি নাই। আসে না, এলেও মেশিন নিয়া দৌড়াদৌড়ি করে চলে যায়। মশা তো মরে না, শুধু একটু গন্ধ ছড়ায়।’
মন্ত্রীর মাঠ এলাকার চা দোকানি আব্দুল হাই বলেন, ‘আমি সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত দোকানে থাকি। দোকানের পেছনেই আমার বাসা। গত দুই-তিন মাসে এদিকে মশা মারার ওষুধ দিতে দেখি নাই।’
তিনি বলেন, ‘আশপাশে বহু ডেঙ্গুরোগী। অনেকে বলতে চান না। অনেককে মুগদা-সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে নিয়ে গেছে। আমার সামনে দিয়েই তো যেতে দেখছি। পরশু রাতে আমার পাশের বাড়িতে একজন না থাকার মতো (সংকটাপন্ন) অবস্থা।’
জানতে চাইলে ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শেখ সেলিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘মশক নিধনে কাজ চলছে। কাজ থেমে নেই। নিয়মিত ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। আমরা মানুষকে সচেতন করছি, এলাকার বাসিন্দারা সচেতন না হলে কোনো কিছুই সম্ভব নয়।’
নির্মাণাধীন ভবনে ডেঙ্গুর প্রজনন হচ্ছে, বিষয়টি দেখভাল করা হচ্ছে কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এ এলাকাটা তো আগে ইউনিয়ন ছিল। এখন অনেক বিল্ডিং (ভবন) নির্মাণ করা হচ্ছে। আমরা তাদের বলেছি- যাতে ভবন নোংরা না রাখা হয়। তারপরও অনেকে নির্দেশনা মানছেন না। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এএএইচ/এএসএ/জেআইএম