হাসপাতালে ফাঁকা নেই বেড, শিশুদের নিয়ে ভয় ‘শক সিনড্রোম’
# আক্রান্ত হচ্ছে এক বছরের কম বয়সী শিশুরাও
# শিশুদের সার্বক্ষণিক মশারির মধ্যে রাখার পরামর্শ
# হাসপাতালে ভর্তিদের বেশিরভাগই শক সিনড্রোমে থাকা শিশু
আতঙ্ক ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু। ছাড়ছে না শিশু-বৃদ্ধ কাউকেই। এক বছরের কম বয়সী শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে ডেঙ্গুতে। এডিস মশাবাহিত এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা গত কয়েক দিনে উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হচ্ছে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে। যাদের মধ্যে রয়েছে শিশুরাও। তবে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি শিশুদের বেশিরভাগই শক সিনড্রোমে থাকা।
ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে থাকাদের সাধারণত শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা হয়। কখনো কখনো শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যায়। এছাড়া কারও কারও ত্বক শীতল হয়ে আসে, ত্বকের ভেতরের অংশে রক্তক্ষরণের কারণে ত্বকের ওপরে লাল ছোপ সৃষ্টি হয়। এছাড়াও আরও নানা উপসর্গ দেখা দেয়।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের ২ নং ওয়ার্ডে ভর্তি আছে ৫ মাস বয়সী শিশু মাইমুনা ইসলাম। শিশুটি তার মা-বাবা ও নানা-নানির সঙ্গে থাকে রাজধানীর আদাবরে। মঙ্গলবার সকালে জ্বর আসে মাইমুনার। পরে পরীক্ষা করলে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়।
আরও পড়ুন: শিশুর ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ কী কী ও কখন হাসপাতালে নেবেন?
শিশুটির মা ইয়াসমিন আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, মঙ্গলবার রাতেই জ্বর বেড়ে গেলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসি। এখানে এসে ডেঙ্গু পরীক্ষা করলে পজিটিভ আসে। হাসপাতালের জরুরি ওয়ার্ডেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করায়। অল্প সময়ের মধ্যেই রেজাল্ট দিয়ে দেয়। ডেঙ্গু পজিটিভ আসার পর থেকেই এই হাসপাতালে ভর্তি আছে। তবে এখন জ্বর কমেছে।
প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। তবে আক্রান্তদের সবাই যে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন তা নয়। সাধারণত শক সিনড্রোম এবং ক্রিটিক্যাল রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, আদাবর এলাকায় বাসায় বাসায় ডেঙ্গুরোগী। আমাদের বাসায় এরই মধ্যে চারজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে।
শ্যামলী এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করেন নাজমুল। ঈদের ছুটিতে স্ত্রী-সন্তান বেড়াতে যায় শনির আখড়ায় আত্মীয় বাড়িতে। সেখানেই জ্বরে আক্রান্ত হয় ২ বছর ১ মাস বয়সী শিশু নাজিফা তাসনিম জারা। পরীক্ষায় ডেঙ্গু পজিটিভ আসার পর এক সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে ভর্তি আছে জারা।
জাগো নিউজকে নাজমুল বলেন, ঈদের ছুটিতে বাসায় তো আর আটকে রাখা যায় না। এসময় মায়ের সঙ্গে নানা বাড়ি বেড়াতে যায় জারা। ওই এলাকায় (শনির আখড়া) ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেশি। একই বাসার ৩ শিশু ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। শনির আখড়ায় ঘরে ঘরে ডেঙ্গুরোগী।
আরও পড়ুন: ডেঙ্গু জ্বর নিয়ন্ত্রণের ঘরোয়া ৫ উপায়
তিনি জানান, জারা আগের তুলনায় কিছুটা সুস্থ। স্যালাইন চলছে, জ্বর কমেছে। হাসপাতালে বেড ভাড়া, ওষুধ ও খাওয়া খরচ মিলিয়ে এক সপ্তাহে ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান তিনি।
জারার মায়ের অভিযোগ, শনির আখড়া এলাকা সিটি করপোরেশনের অধীনে হলেও এখানে মশার ওষুধ ছিটানো হয় না। এখানে মশার প্রকোপ অনেক বেশি। গতবছর শনির আখড়া গিয়ে আমি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছি। এবার আমার বাচ্চা আক্রান্ত হলো।
দেশে প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। তবে আক্রান্তদের সবাই যে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন তা নয়। সাধারণত শক সিনড্রোম এবং ক্রিটিক্যাল রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে। প্রতিদিনই হাসপাতালে বাড়ছে ডেঙ্গুরোগীর চাপ। ব্যতিক্রম নয় ঢাকার শ্যামলীতে অবস্থিত বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট। এই হাসপাতালের নিচতলার ২ নম্বর ওয়ার্ড ডেঙ্গুরোগীদের জন্য ডেডিকেটেড থাকলেও রোগীর চাপে অন্য ওয়ার্ডেও ডেঙ্গুরোগী ভর্তি করা হচ্ছে।
শুক্রবার (১৪ জুলাই) সরেজমিনে শিশু হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, হাসপাতালের ২ নম্বর ওয়ার্ডে আসন (বেড) আছে ৪২টি। সব বেডেই এখন রোগী ভর্তি। এখন নতুন ডেঙ্গুরোগীদের ৭ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হচ্ছে। এরপরও রোগীর চাপ থাকায় যেখানেই বেড খালি হচ্ছে সেখানেই ডেঙ্গুরোগীদের ভর্তি করা হচ্ছে। বর্তমানে শিশু হাসপাতালে ভর্তি আছে ৬০ ডেঙ্গুরোগী। গত শনিবারের পর মাত্র একজন ডেঙ্গুরোগী এই হাসপাতালে ভর্তি হতে পেরেছে। হাসপাতালের আসন ফাঁকা না থাকায় রোগী আসলেও ভর্তি করানো সম্ভব হচ্ছে না।
আরও পড়ুন: ৫০ টাকায় হবে ডেঙ্গু পরীক্ষা
হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুক্রবার সকাল থেকে আসা বেশিরভাগ শিশুই জ্বর নিয়ে এসেছে। অনেকেরই প্রাথমিকভাবে ডেঙ্গু ধরা না পড়ায় তাদের অন্যান্য টেস্ট ও ওষুধ দেওয়া হয়েছে। তবে যাদের ডেঙ্গু পজিটিভ এসেছে তাদেরকেও হাসপাতালে ভর্তি করা যাচ্ছে না। এমনকি ক্রিটিক্যাল রোগীদেরও ভর্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। বাধ্য হয়েই অন্য হাসপাতালে রেফার করা হচ্ছে।
অন্য হাসপাতালে মেঝেতে আসন পেতে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হলেও শিশু হাসপাতালে তা সম্ভব নয়। ফলে যত বেড আছে তার বেশি রোগী ভর্তি করা সম্ভব হয় না।
২ নম্বর ওয়ার্ডে দায়িত্বরত এক চিকিৎসক জাগো নিউজকে জানান, সাধারণত শক সিনড্রোমে থাকা রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে। তাদের নিয়মিত অবজারভেশনে রাখা হচ্ছে। তবে বেশি ক্রিটিক্যাল রোগীও কয়েকজন আছে, তাদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে। এদের সংখ্যা ২-৩ জন। ২ নম্বর ওয়ার্ডে থাকা রোগীদের অবস্থা মোটামুটি ভালো। তাদের প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়া হচ্ছে। ডেঙ্গুরোগীদের জন্য সবচেয়ে বড় বিষয় ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট। আমরা সেটা খেয়াল রাখছি।
ডেঙ্গুরোগীদের দেখভাল ও সুস্থদের ছাড়পত্র দিয়ে সেখানে নতুন রোগী ভর্তি করা যায় কি না সে বিষয়ে দেখাশোনা করতে শুক্রবার ছুটির দিনেও হাসপাতালে আসেন শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম। জুমার নামাজ শেষে হাসপাতালে এসে ডেঙ্গুর ওয়ার্ডসহ বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখেন তিনি।
আরও পড়ুন: ডেঙ্গু সারাতে পেঁপে পাতা যেভাবে কাজ করে
এসময় অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের এই প্রতিবেদকের। ডেঙ্গুরোগীর চাপে হাসপাতালে হিমশিম অবস্থার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, অন্য হাসপাতালে মেঝেতে আসন পেতে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হলেও শিশু হাসপাতালে তা সম্ভব নয়। ফলে যত বেড আছে তার বেশি রোগী ভর্তি করা সম্ভব হয় না। এখন প্রতিদিন রোগীর চাপ বাড়ছে। আমরা ৭ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ড ডেঙ্গুরোগীদের জন্য স্ট্যান্ডবাই রেখেছি। প্রতিনিয়ত রোগী বাড়ছে। এভাবে বাড়তে থাকলে এসব ওয়ার্ড ডেঙ্গুরোগীদের জন্য ডেডিকেট করা হবে।
ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমাদের কাছে নতুন রোগীরা আসছে। কিন্তু আসন সংকটে তাদের ভর্তি করানো যাচ্ছে না। আমি আজ হাসপাতালে এসেছি মূলত এই কারণে, ডেঙ্গুর পুরোনো রোগীদের মধ্যে যারা সুস্থ হয়েছে তাদের রিলিজ (ছাড়পত্র) দেওয়া যায় কি না সেটা দেখতে।
জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ৬৫ ডেঙ্গুরোগী শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয় উল্লেখ করে এই হাসপাতালের পরিচালক বলেন, অথচ চলতি (জুলাই) মাসে এরই মধ্যে ১৩৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত ভর্তি হয়েছে। যা আগের সব মাসের তুলনায় দ্বিগুণ। বর্তমানে ৬০ জন রোগী এখানে ভর্তি আছে, যাদের বেশিরভাগই শক সিনড্রোমে আছে। আমরা তা দেখেই ভর্তি করি। অন্যথায় সাধারণভাবে চিকিৎসা দেওয়া গেলে তাদের পরামর্শ দিয়ে বাড়িতে পাঠানো হয়। তবে বাড়িতে শরীর খারাপ কিংবা নতুন করে উপসর্গ দেখা দিলে যেন হাসপাতালে আনা হয় সে বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে আশার কথা, ডেঙ্গুর সময়ে অন্য রোগী কম আসে। এই কারণে কিছুটা সুবিধা হয়। তবে আজ দুই-তিনজন ডায়রিয়ার রোগী এসেছে।
শিশুরা জ্বরে আক্রান্ত হলে তিন দিনের মধ্যেই ডেঙ্গু পরীক্ষা ও সিবিসি করতে হবে। পাশাপাশি দিনে-রাতে সবসময় শিশুদের মশারির মধ্যে রাখতে হবে। মশা এখন চরিত্র বদলেছে, কামড়ানোর সময়ও বদলে গেছে।
আরও পড়ুন: ডেঙ্গু রোগীকে যেসব খাবার খাওয়ানো জরুরি
এবার এক বছরের কম বয়সী অনেক শিশু ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসছে। এটাকে ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আগে এক বছরের কম বয়সী ডেঙ্গুরোগী কম পাওয়া যেত। যারা ডায়াবেটিস, ক্যানসার, রক্তচাপসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত তাদের কোমরবিডিটি বলা হয়। এক বছরের কম বয়সী ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদেরও কোমরবিডিটি রোগী ধরা হয়। এদের আমরা একটু বিশেষ খেয়াল রাখি। এদের ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট একটু ডিফিকাল্ট হয়। এক্ষেত্রে ফ্লুইড ম্যানেজমেন্টে সমস্যা হলেই রোগী খারাপ অবস্থায় চলে যায়।
শিশুদের অভিভাবকদের পরামর্শ দিয়ে এ চিকিৎসক বলেন, শিশুরা জ্বরে আক্রান্ত হলে তিন দিনের মধ্যেই ডেঙ্গু পরীক্ষা ও সিবিসি বা কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট পরীক্ষা করতে হবে। পরীক্ষার পর ডেঙ্গু শনাক্ত না হলে তো চিন্তা কমে গেলো। তবে ডেঙ্গু পজিটিভ হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। পাশাপাশি দিনে-রাতে সবসময় শিশুদের মশারির মধ্যে রাখতে হবে। মশা এখন চরিত্র বদলেছে, কামড়ানোর সময়ও বদলে গেছে। তাই সবসময় আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
এএএম/কেএসআর/জিকেএস