মুগদা হাসপাতাল

ডেঙ্গু ওয়ার্ডে মশারিতে অনীহা, বেশি রোগী আসছে জটিলতা নিয়ে

আবদুল্লাহ আল মিরাজ
আবদুল্লাহ আল মিরাজ আবদুল্লাহ আল মিরাজ , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৬:৪২ পিএম, ২২ জুন ২০২৩
ডেঙ্গু ওয়ার্ডে মশারি ছাড়াই থাকছেন রোগীরা/জাগো নিউজ

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে বাড়ছে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর প্রকোপ। এবার বর্ষা মৌসুমের আগে থেকেই বাড়তি ডেঙ্গুর সংক্রমণ। প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে তিন-চারশ রোগী। সংক্রমণের মৌসুম শুরু হওয়ায় এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এবার ভিন্ন লক্ষণ ও জটিলতা নিয়ে বেশি রোগী হাসপাতালে আসছেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

সরেজমিনে রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি ডেঙ্গুরোগী ভর্তি হাসপাতালে। রোগীর চাপ সামাল দিতে মেঝেতে থাকার ব্যবস্থা করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে ডেঙ্গু ওয়ার্ডের কোথাও মশারি টানাতে দেখা যায়নি। রোগীরা গরমের জন্য মশারি টানাচ্ছেন না। যদিও ডেঙ্গুরোগীদের জন্য মশারি অনেকটা অপরিহার্য। কর্তৃপক্ষেরও বিষয়টি নিয়ে বেশি কড়াকড়ি করতে দেখা যায়নি।

jagonews24

আরও পড়ুন>> বাড়ছে ডেঙ্গুর চোখ রাঙানি, আক্রান্ত-মৃত্যুর রেকর্ড ভাঙার শঙ্কা 

মুগদা হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ৫শ শয্যার এ হাসপাতালে ২১ জুন সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু ও অন্য বিভিন্ন অসুস্থতা নিয়ে ভর্তি আছে ৯৫৩ জন রোগী। এর মধ্যে শুধু ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ৩০৩ জন। ২২৮ জন প্রাপ্তবয়স্ক ও ৭৫ জন শিশু। গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছে ১০২ জন রোগী। এছাড়া এ সময়ে ছাড়া পেয়েছেন ৮৪ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১ জানুয়ারি থেকে ২১ জুন পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন পাঁচ হাজার ৯২৪ জন। এদের মধ্যে রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন চার হাজার ৬২১ জন। আর ঢাকার বাইরে অন্য বিভাগে ভর্তি এক হাজার ৩০৩ জন। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে আরও দুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। একই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৬০ জন রোগী।

যাত্রাবাড়ীর দনিয়া এলাকার বাসিন্দা ১৪ বছর বয়সী মো. সাকিবুল হাসান। গত চারদিন ধরে মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি। তার মা জাগো নিউজকে বলেন, প্রথম দিন সকালে জ্বর দেখা দেয় ছেলের। কিন্তু বৃষ্টিতে ভেজায় তার অসুস্থতাকে ঠান্ডাজ্বর ভেবেছিলাম আমরা। এ সময়ে সাধারণ জ্বরের ওষুধ খাওয়ানো হয়। এর পরদিন হঠাৎ অনেক বেশি কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। আর অপেক্ষা না করে নিকটস্থ হাসপাতালে গেলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না থাকায় মুগদা মেডিকেলে আসি। চারদিন ধরে ভর্তি। তার প্লাটিলেটও কমে যাচ্ছিল। চিকিৎসক বলেছেন ঠিক হয়ে যাবে।

jagonews24

আরও পড়ুন>> ডেঙ্গু পরীক্ষায় ৫০০ টাকার বেশি নিলে ব্যবস্থা: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর 

যাত্রাবাড়ীর দনিয়ায় একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করেন ২০ বছর বয়সী আসিফ। পাঁচদিন ধরে অসুস্থ। গ্রাম থেকে মা এসেছেন হাসপাতালে তার দেখাশোনার জন্য। আসিফ বলেন, শুক্রবার অনেক জ্বর আসে। তবে ভালো হয়ে যাবে মনে করে তেমনভাবে চিকিৎসা নেইনি। শনিবার জ্বর বেড়ে যাওয়ায় অন্যদের সহায়তায় হাসপাতালে ভর্তি হই। এর মধ্যে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। নিশ্বাসের সমস্যা হওয়ায় গ্যাস (নেবুলাইজার) নিয়েছিলাম। এখনো থেমে থেমে অনেক জ্বর আসে। তবে আগের চেয়ে কিছুটা ভালো আছি।

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০ম তলায় ডেঙ্গুর পুরুষ ওয়ার্ড ঘুরে জানা যায় রামপুরা, বনশ্রী থেকে শুরু করে চিটাগাং রোড পর্যন্ত এলাকার রোগীরা এই হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। তবে বেশিরভাগই রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা।

jagonews24

সরজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালটির তৃতীয় তলায় নারী, সপ্তম তলায় শিশু ও ১০ম তলায় পুরুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা ভর্তি আছেন। অতিরিক্ত রোগী মেঝেতে হাসপাতালের পেতে দেওয়া বেডে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বেডগুলোতে মশারি দেওয়া হলেও টানায়নি কেউ। গরমের কারণে মশারি টানানো সম্ভব হয় না বলে জানান রোগীরা।

মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. নিয়াতুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের হাসপাতালে ডেঙ্গুরোগী ধারণ সক্ষমতা ২৫০ জন। এর মধ্যে এখন ভর্তি আছেন তিন শতাধিক। চাইলে আরও রোগী ভর্তির সক্ষমতা তৈরি করা যায়। তবে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের ফ্লোরিংয়ে রাখাটা অমানবিক। তবে হাসপাতালে রোগী চিকিৎসা নিতে চাইলে ফিরিয়ে দেওয়া যায় না।

আরও পড়ুন>> শক্তিশালী স্প্রে আনা হয়েছে, মশা মারলে ডেঙ্গু কমে যাবে: মন্ত্রী 

চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এবছর রোগীরা আগের ডেঙ্গু আক্রান্তদের তুলনায় ভিন্ন লক্ষণ নিয়ে আসছেন। প্রথমবার কোনো রোগী ডেন-১ ধরন আক্রান্ত হলে পরবর্তীসময়ে তিনি যদি ডেন-২ বা ডেন-৩ আক্রান্ত হন তাহলে কিছু জটিলতা দেখা দেয়। এরকম রোগীদের বলা কমপ্লিকেটেড ডেঙ্গু অথবা এক্সটেন্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম। এবার এ ধরনের রোগী বেশি আসছে। এছাড়া এবারের রোগীদের শরীর ফুলে যাওয়া, পেটে পানি জমা, ব্লাড প্রেশার কমে যাওয়া, মস্তিষ্কের প্রদাহজনিত সমস্যা থাকছে।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক তাহমিনা শিরিন জাগো নিউজকে বলেন, এবার ডেন-২ এবং ডেন-৩ এ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে সমস্যা বাড়ছে।

jagonews24

নতুন ধরনে আক্রান্তের ফলে কী ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একই ধরনে রোগী যদি আবার আক্রান্ত হয় সেক্ষেত্রে দেখা যায় তার শরীরে এন্টিবডি কাজ করে। কিন্তু রোগী যদি নতুন কোনো ভেরিয়্যান্টে আক্রান্ত হয় তখন তারা আবারও অসুস্থ হয় এবং নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। যেমন প্রথমবার রোগী যদি ডেন-১ এ আক্রান্ত হয়ে পরবর্তীসময়ে আবারও ডেন-২ বা ডেন-৩ এ আক্রান্ত হয় তখন জটিলতা তৈরি হয়। এ ধরনের কমপ্লিকেটেড ডেঙ্গুতে আক্রান্তের ফলে দেখা যায় যেখানে রোগীরা সাধারণত দু-তিনদিন ভর্তি থাকতো, সেখানে ভর্তি থাকছে পাঁচ-সাতদিন।

মুগদা মেডিকেলে অন্য হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গুরোগী বেশি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই এলাকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত বেশি। আর মুগদার আশপাশের এলাকার মানুষজন এখানে আসতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

জ্বর হলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে বলে জানিয়ে তাহমিনা শিরিন বলেন, এখন যেসব কমপ্লিকেশন নিয়ে রোগীরা আসছে তাদের বেশিরভাগই দেরি করে হাসপাতালে আসছেন। এমনটা করা যাবে না। কেউ ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে তাদের তরল খাবার খাওয়াতে হবে। মশারি টানিয়ে রাখতে হবে। যেহেতু এই মশা দিনে কামড়ায় তাই শিশুদের দিনের বেলায় মশারিতে ঘুমানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

এএএম/এএসএ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।