জলাতঙ্ক আতঙ্ক (শেষ পর্ব)
পোষা কুকুর-বিড়ালে আক্রান্তের হার বেশি, ভয়ে বলে না শিশুরা
অডিও শুনুন
বেওয়ারিশ কুকুরের পাশাপাশি প্রতিদিন ঘরে পোষা কুকুর-বিড়ালের আঁচড় কিংবা কামড়ের শিকার হচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। বাসায় অতি যত্নে লালন-পালন করা প্রাণীটি আঁচড় দিলে অনেক সময় গুরুত্ব দেন না কিংবা এড়িয়ে যান। চিকিৎসকরা বলছেন, প্রতিদিন হাসপাতালে টিকা নিতে যাওয়া মানুষের বেশিরভাগই ঘরে পোষা প্রাণীর মাধ্যমে আক্রান্ত। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশুরা ভয়ে আঁচড়-কামড়ের কথা বাবা-মাকে বলে না। সময়মতো টিকা না নিলে পোষা প্রাণীর কামড়েও হতে পারে মৃত্যু।
সরেজমিনে মহাখালী জাতীয় সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, নিজের পোষা বিড়াল আঁচড় দেওয়ায় জলাতঙ্কের টিকা নিতে এসেছেন নওশিন তাবাসসুম নৌমি (২২)। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, পরিবারের সবাই যখন ডাইনিং টেবিলে খেতে বসেছি তখন পায়ের নিচে বসে থাকা বিড়ালটি আচমকা আঁচড় দেয়। এতে তিন-চারটি দাগ বসে যায় এবং হালকা রক্তও বের হয়। খাওয়া ফেলে রেখে বিড়ালকে টিকা দিতে ও নিজে জলাতঙ্কের টিকা নিতে হাসপাতালে ছুটে এসেছি।
আরও পড়ুন>> বছরে টিকা নেন ৪ লাখ মানুষ, রোগাক্রান্ত হলেই নিশ্চিত মৃত্যু
রাজধানীর ফার্মগেট থেকে চার বছরের শিশু মায়া আক্তার মাহিকে নিয়ে জলাতঙ্কের টিকা নিতে এসেছেন আব্দুল মান্নান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ঘরে একটি পোষা বিড়াল আছে। রাতে বিড়ালের সঙ্গে খেলা করছিল মেয়ে। এমন সময় বিড়াল মেয়েটির মুখে আঁচড় দেয়। এজন্য জলাতঙ্কের টিকা দিতে হাসপাতালে এসেছি।
১৩ বছর বয়সী রেদওয়ান হোসেন রোনক ঘরে পালিত বিড়ালকে আদর করে চুমু দিতে গিয়ে ঠোঁটে কামড় খায়। বাবা-মায়ের ভয়ে প্রথম দিকে কাউকে না জানালেও ছয়দিন পর তার বাবা জানতে পেরে টিকা দিতে এনেছেন।
মিরপুরের কাজীপাড়া থেকে সাড়ে তিন বছরের শিশু হাফসাকে সঙ্গে নিয়ে টিকা নিতে এসেছেন তার মা নাসরিন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, চার মাস বয়সী একটি বিড়াল ঘরে লালন-পালন করছি। হাফসা বিড়ালের সঙ্গে প্রায়ই খেলা করে। একদিন হাফসার হাতে কামড় দেয় বিড়ালটি।
আরও পড়ুন>> রাজধানীতে কুকুরের কামড়ে শিশুর মৃত্যু
সাড়ে তিন বছরের শিশুকে প্রথম দিনে একসঙ্গে পাঁচটি টিকা দেওয়া হয় জানিয়ে হাফসার মা জানান, দুই হাতে দুটি এবং কামড়ানোর জায়গায় তিনটি ইনজেকশন দেয়।
জাতীয় সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, রাস্তার কুকুরের কামড়ে যেমন প্রতিনিয়ত রোগীরা টিকা নিতে আসছেন, তেমন ঘরে পোষা প্রাণীর আঁচড়/কামড়ের কারণেও টিকা নিতে আসছেন। আগের তুলনায় সচেতনতা বেড়েছে। তবে অনেক সময় ছোট শিশুদের কুকুর-বিড়াল আঁচড়/কামড় দিলে তারা ভয়ে কাউকে বলতে চায় না। এক্ষেত্রে শিশুদের আগে থেকে সচেতন করা জরুরি।
চিকিৎসকরা বলছেন, ছোট হওয়ায় কুকুর শিশুর শরীরের ওপরের অংশে কামড়ানোর সুযোগ বেশি পায়, যা বিপজ্জনক। স্নায়ুতন্ত্র বেয়ে সংক্রমণ দ্রুত মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়। শিশুরা কুকুর-বিড়াল নিয়ে খেলাধুলা করে, মাঝে মধ্যে বিরক্ত করে, রাগায়। শিশুর ত্বক নরম হওয়ায় ইনজুরি বেশি মাত্রার হয়। কুকুর-বিড়াল কামড়েছে- এ কথা মা-বাবা জেনে গেলে বকবে বা ইনজেকশন দিতে হবে, এই ভয়ে তারা বেশিরভাগ সময় বিষয়টা গোপন রাখে।
আরও পড়ুন>> মুলাদীতে কুকুরের কামড়ে আহত ৩০, শিশুর মৃত্যু
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (সিডিসি) জুনোটিক ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের কর্মকর্তারা জানান, ২০১৮ সালে সারাদেশে টিকা নেন দুই লাখ ৫৩ হাজার ৪০৯ জন। একই সঙ্গে চার লাখ ৬৮ হাজার ৯৩৭টি কুকুরকে টিকার আওতায় আনা হয়। একই বছর জলাতঙ্কে মারা যান ৫৭ জন। আর সবশেষ ২০২২-এর জুলাই পর্যন্ত টিকা নিয়েছেন চার লাখ ১০ হাজার ৫৬ জন। এক লাখের বেশি কুকুরকে টিকার আওতায় আনা হয়েছে। জলাতঙ্কে মারা গেছেন ২৪ জন মানুষ।
গত ১০ বছরে ২৭ লাখ ৯২ হাজার ৮২১ জন মানুষকে জলাতঙ্কের টিকা দেওয়া হয়েছে। আর ভ্যাকসিনের আওতায় আনা হয়েছে ২৪ লাখ কুকুর।
২০১০ সাল থেকে আহত, বিপন্ন কুকুর-বিড়ালসহ অবহেলিত প্রাণীদের সেবাদাতা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রবিনহুড দ্য অ্যানিমেল রেসকিউয়ারের প্রতিষ্ঠাতা আফজাল খান জাগো নিউজকে বলেন, নিজের ৭০টির মতো কুকুর-বিড়াল রয়েছে। সবগুলোর নিজের হাসপাতালে জলাতঙ্কের টিকা দেওয়া আছে। এছাড়া প্রতিনিয়ত আটকে পড়া প্রাণীদের উদ্ধারে কাজ করতে হয়। অনেক সময় উদ্ধার করতে গিয়ে প্রাণী আঁচড়-কামড় দেয়। তবে আমাদের টিমের সবার জলাতঙ্কের টিকা নেওয়া আছে।
আরও পড়ুন>> বেওয়ারিশ কুকুরের কামড়ে অর্ধশত গরু-ছাগলের মৃত্যু
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শাহাবুদ্দিন আহমেদের নিজের বিড়াল আছে ১২টি। প্রতিনিয়ত বিড়ালগুলো খাওয়ানো, যত্ন নেওয়া, গোসল করানো, নখ কেটে দেওয়া থেকে শুরু করে সব কাজ একাই করেন তিনি।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে মোহাম্মদপুরে থাকি। সঙ্গে ১২টি বিড়াল আছে। বিড়াল যাতে আঁচড়/কামড় দিলেও জলাতঙ্ক না হয় এজন্য বিড়ালসহ পরিবারের সবাই প্রতিনিয়ত টিকা নেই।
জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ ও উপসর্গ
জলাতঙ্কের উপসর্গ ও লক্ষণগুলো রোগের শেষ পর্যায়ে দেখা যায়। এই সময়ের মধ্যে ভাইরাসটি মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়ে এনসেফালাইটিস সৃষ্টি করে এবং এর পরই মৃত্যু ঘটে।
জলাতঙ্কের একটি ইনকিউবেশন পিরিয়ড থাকে, যার অর্থ হলো উপসর্গ ও লক্ষণগুলো প্রকাশের আগে কিছুদিন এটি ব্যক্তির শরীরে সুপ্ত থাকে। প্রাথমিক উপসর্গ মাথাব্যথা, গলাব্যথা, জ্বর ও কামড়ের জায়গায় খিঁচুনি।
অত্যধিক লালা নিঃসরণ, গিলতে অসুবিধা, গিলতে অসুবিধার কারণে পানির ভয়, উদ্বেগ, বিভ্রান্তি, অনিদ্রা এমনকি আংশিক পক্ষাঘাত এবং কখনো কোমার মতো লক্ষণগুলো জলাতঙ্কের ইঙ্গিত দেয়। ব্যক্তি শব্দ, আলো এমনকি বাতাসের ঠান্ডা স্রোতে অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। বাতাসের ভয় (অ্যারোফোবিয়া) দেখা যায়।
নওশিন তাবাসসুম নৌমি
কোথায় কীভাবে পাবেন টিকা
বিনামূল্যে জলাতঙ্কের টিকা দেয় সরকার। হাসপাতালে যাওয়ার পর চিকিৎসক ক্ষতস্থান দেখে টিকা দেন। টিকা নিতে হাসপাতালে যাওয়া লাগে সপ্তাহখানেক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে সারাদেশের জেলা হাসপাতাল ও কিছু উপজেলা হাসপাতাল পর্যায়ে জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে।
জাতীয় সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, প্রতিদিন তিন থেকে চারশ রোগীকে টিকা দেওয়া হয় শুধু এই হাসপাতাল থেকে। সরকারি ছুটির দিনসহ সপ্তাহে সাতদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত প্রতিদিন বিনামূল্যে সেবা দেওয়া হয়।
ঘরে পোষা প্রাণীর কামড়-আঁচড় খেয়ে বেশি রোগী আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, দিনে অর্ধেকের বেশি রোগী আসছে ঘরে পোষা কুকুর-বিড়ালের আঁচড় কিংবা কামড় খেয়ে। অনেক সময় শিশুরা আক্রান্ত হয়। কামড়েছে- এ কথা মা-বাবা জেনে গেলে বকবে বা ইনজেকশন দিতে হবে, এই ভয়ে তারা বেশিরভাগ সময় বিষয়টি গোপন রাখে। ছোটবেলা থেকে বিষয়টি নিয়ে সতর্ক করতে হবে।
ছোটবেলা থেকে শিশুদের কুকুর-বিড়ালের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ ও তাদের উত্ত্যক্ত না করার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এতে ছোটবেলা থেকেই শিশুরা বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (সিডিসি) জুনোটিক ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. এস এম গোলাম কায়সার জাগো নিউজকে বলেন, গৃহপালিত কুকুর-বিড়াল যদি কাউকে আঁচড় বা কামড় দেয় অবশ্যই তাকে টিকা নিতে হবে। জলাতঙ্ক শতভাগ মরণব্যাধি ও শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য। যদি কোনো ব্যক্তি জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয় সে বাঁচবে না, তার মৃত্যু নিশ্চিত।
টিটি/এএসএ/জিকেএস