ভাইরাস আতঙ্কেই বছর পার
করোনাভাইরাস, মাঙ্কিপক্স, ডেঙ্গু- এ তিন ভাইরাস আতঙ্কেই বছর পার করেছেন দেশের মানুষ। যদিও মাঙ্কিপক্স দেশে শনাক্ত হয়নি, তবে বছরের মাঝামাঝি সময়ে আফ্রিকা ও ইউরোপে এ রোগের ব্যাপক প্রাদুর্ভাবের কারণে বাংলাদেশেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবছরও ডেঙ্গু সংক্রমণের ভীতি কাটেনি। বরং শনাক্ত ও মৃত্যু অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়েছে।
করোনাভাইরাস আতঙ্ক
২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়। এরপর থেকে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে। ২০২২ এর শুরুর দিক থেকে কমে আসে সংক্রমণ। তবে দফায় দফায় সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি ভীতির সৃষ্টি করে জনমনে। এ বছর জুন-জুলাইয়ে করোনার প্রাদুর্ভাব বাড়লে চতুর্থ ঢেউয়ের আশঙ্কা করেন বিশেষজ্ঞরা। প্রতিবেশী দেশ ভারত, চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নতুন করে সংক্রমণ বৃদ্ধিতে সে শঙ্কা আরও প্রবল হয়। তবে বছরের শেষ দিকে এসে করোনা সংক্রমণের ধারা নিম্নমুখী হয়।
এদিকে চলতি বছর করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকার সংকট কেটে যাওয়ায় গণটিকা ও বুস্টার ডোজ দেওয়ার নানা উদ্যোগ নেয় সরকার। আতঙ্ক থাকলেও ২০২২ সালে করোনায় সংক্রমণ ও মৃত্যু হার কমে আসে। মহামারির শুরু থেকে গত ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশে ২৯ হাজার ৪৩৭ জনের মৃত্যু এবং ভাইরাসটিতে মোট শনাক্ত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ লাখ ৩৬ হাজার ৮৯৭ জনে।
করোনার সংক্রমণ রোধে সরকারের টিকাদান মহাযজ্ঞের আওতায় গত ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ৩৩ কোটি ৪৮ লাখ ৪২ হাজার ৯৮৪ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে প্রথম ডোজ ১৪ কোটি ৮৫ লাখ ৬০ হাজার ৭৩৮টি, দ্বিতীয় ডোজ ১২ কোটি ৫৬ লাখ ৭০ হাজার ৬২৭টি এবং বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়েছে ৬ কোটি ৬ লাখ ১১ হাজার ৬১৯টি।
চলতি বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে সারাদেশে ২১ কোটি ৪২ লাখ ২১ হাজার ২৬ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে প্রথম ডোজ ৭ কোটি ৪৬ লাখ ৯১ হাজার ১৮৫টি, দ্বিতীয় ডোজ ৭ কোটি ৫০ লাখ ১৪ হাজার ৭৭টি এবং বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়েছে ৬ কোটি ৪৫ লাখ ১৫ হাজার ৭৬৪টি।
মাঙ্কিপক্স
করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা কাটতে না কাটতেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চোখ রাঙানো শুরু করে ভাইরাসজনিত রোগ মাঙ্কিপক্স। বিশেষত আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিশ্বের প্রায় ১২টি দেশে এ রোগের সংক্রমণ ঘটে। গত আগস্ট মাসে প্রতিবেশী দেশ ভারতেও মাঙ্কিপক্স আক্রান্ত রোগী শনাক্তের খবর পাওয়া যায়। এ নিয়ে বাংলাদেশেও ভীতিকর অবস্থা তৈরি হয়। সংক্রমণ এড়াতে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেশের স্থল, বিমান ও নৌপথে সতর্কতা জারি করে। এরমধ্যে ঢাকায় চর্মরোগে আক্রান্ত একজন তুরস্কের নাগরিকের দেহে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়েছে, এমন খবরে হইচই পড়ে যায়। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ওই ব্যক্তিকে মাঙ্কিপক্স আক্রান্ত রোগী নয় বলে জানায়। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব ঘটেনি।
ডেঙ্গু ভাইরাসের ভয়াবহতা
ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল এ তিন মাস বাদ দিলে বছরের প্রায় পুরোটা সময়ই দেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর প্রভাব ছিল। জুন মাস থেকে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা মারাত্মক রূপ নেয়। সেপ্টেম্বরে ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকা ছাড়াও কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়ে। এসময় দেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গুরোগীর শয্যা সংকট দেখা দেয়। আগের বছরগুলোতে সেপ্টেম্বরের শেষে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে এলেও এ বছর সেপ্টেম্বরের পর সংক্রমণ ছিল ঊর্ধ্বমুখী।
অতীতের যে কোনো বছরের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যু দেখলো বাংলাদেশ। এডিস মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়ে চলতি বছর এ পর্যন্ত মারা গেছেন ২৭১ জন, যা দেশের ইতিহাসে এক বছরে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে ১৭৯ জনের মৃত্যু হয়। চলতি বছরের ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে দেশে ২৭১ জনের মৃত্যু হয়, যা ২০১৯ সালের সর্বোচ্চ মৃত্যুর সংখ্যাও ছাড়িয়ে যায়। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ৬১ হাজার ৪০৮ জন। এরমধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৩৮ হাজার ৬৮৮ জন এবং ঢাকার বাইরের ২২ হাজার ৭২০ জন।
ভাইরাস ছাড়াও ব্যাকটেরিয়াজনিত ডায়রিয়ার প্রকোপ ও শঙ্কা ছড়িয়েছিল বছরের মার্চ ও এপ্রিল মাসের দিকে। গরমের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মাঝে এই পানিবাহিত ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়তে থাকে। এ অবস্থা চলমান থাকে অক্টোবর পর্যন্ত। এতে রাজধানীর মহাখালী কলেরা হাসপাতাল আইসিডিডিআর,বিতে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের চাপ বাড়ে।
ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রামক রোগ ছাড়াও দেশে অসংক্রামক রোগের প্রবণতাও বাড়ছে। হৃদরোগ, ক্যানসারসহ ভয়াবহ অনেক রোগে নিয়মিত মারা যাচ্ছেন মানুষ। করোনা পরবর্তী সময়ে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হলেও এখনো দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিশ্বমানের হয়নি। তবে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতিতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ বদ্ধপরিকর বলে জানান স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা।
এএএম/এমকেআর/জিকেএস