সরেজমিন শিশু হাসপাতাল
সিট খালি নেই ডেঙ্গু ওয়ার্ডে, মশারি ছাড়াই থাকছে রোগীরা
হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে বেড়েই চলছে রোগীর সংখ্যা। প্রতিদিন যে পরিমাণে রোগী আসছে, সম্ভব হচ্ছে না তাদের ভর্তি নেওয়া। জরুরি অবস্থায়ও সম্ভব হচ্ছে না রোগীদের আইসিইউ-সিসিইউতে রাখা। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রোগীদের লম্বা লাইন লেগেই থাকছে। এমন পরিস্থিতিতেও মশারি ছাড়াই ডেঙ্গু ওয়ার্ডের বেডে রোগীদের শুইয়ে রাখছেন স্বজনরা। প্রতিটি ওয়ার্ডেই মশার প্রকোপ দেখা গেলেও সেদিকে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই।
রোববার (১৬ অক্টোবর) বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে সরেজমিনে ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
আট মাসের শিশু সাবুয়াত। ছয়দিন ধরে অসুস্থ। শুরুতে টানা পাঁচদিন জ্বর থাকায় ফার্মেসি থেকে ওষুধ খাওয়ালেও কাজ হয়নি। শ্যামলীর একটি টিনশেড বাড়িতে ভাড়া থাকেন সাবুয়াতের বাবা-মা। বাবা একটি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাকর্মী। সন্তানের এমন পরিস্থিতিতে শুরুতে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেন। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডেঙ্গু ধরা পড়ায় সাবুয়াতকে শ্যামলীর শিশু হাসপাতালে নিয়ে আসেন।
সাবুয়াতের মা শিরিন আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, ‘ছয়দিন ধরে ছেলে অসুস্থ। দিনরাত কান্নাকাটি করতাছে। গত চারদিন আগে শিশু হাসপাতালে ভর্তি করাইছি। একদিন অপেক্ষা কইরা ওয়ার্ডে বেড পাইছি। ছেলেডা কিছুই খাইতাছে না। স্যালাইন দিয়া রাখছে। সকালে জ্বর না থাকলেও বিকালে, রাইতে আইতাছে। জমানো টাকা সব শেষ। এহন ধার কইরা চিকিৎসা করতেছি।’
চিকিৎসক কী বলেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানের চিকিৎসকরা সকাল বিকাল দেখে যাচ্ছেন। নানা ধরনের ওষুধ স্যালাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে।
জরুরি বিভাগে উপচেপড়া ভিড়
শিশু সাবুয়াত আছে হাসপাতালের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের ১৬ নম্বর বেডে। ১৪ নম্বর ওয়ার্ডেরই আরেক বেডে আছে ১০ বছরের মিম। মিরপুরের একটি মাদরাসায় তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে মিম। মিরপুর-১ নম্বরে তাদের বাসা। মা শান্তা একজন গার্মেন্টকর্মী। বাবা দিনমজুর। এক সপ্তাহ ধরে মিমের জ্বর।
মিমের মা শান্তা জানান, শুরুতে তাকে মিরপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিলে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। সেখানে সিট না থাকায় শ্যামলীতে আনা হয়। এখানে চিকিৎসকরা তাকে আইসিইউতে ভর্তির পরামর্শ দেন। তবে অর্থ সংকটের কারণে তা সম্ভব হয়নি। এ কারণে ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হয়েছে।
শান্তা বলেন, ‘মাইয়াডা খালি কান্দে, কিছু খায় না, ঘুমায় না। রাতে স্যালাইন লাগাইছে। একটার পর একটা স্যালাইন দিতাছে। মাইয়াডারে সুস্থ করতে সব কষ্ট ভুইলা গিয়া হাসপাতালে পইড়া আছি।’
এভাবেই অসংখ্য রোগী ডেঙ্গু নিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে এই হাসপাতালে। সবারই রয়েছে এমন করুণ গল্প।
হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, নিচতলার ২ নম্বর ও চতুর্থ তলার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে ডেঙ্গু সেল তৈরি করা হয়েছে। সেখানে ৬০ জন রোগী ভর্তি করানো হয়েছে। এর বাইরে আইসিইউ, সিসিইউ ও অন্যান্য ওয়ার্ডে ১৭ জন রোগী রাখা হয়েছে। অধিকাংশ ডেঙ্গু রোগীর বেডে মশারি দেখা যায়নি। প্রতিটি রোগীর সঙ্গে রয়েছেন এক থেকে তিনজন করে স্বজন। ওয়ার্ডের ভেতরে উড়ছে মশা। মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু সংক্রমণের প্রবল আশঙ্কা থাকলেও সেদিকে কারও গুরুত্ব নেই।
জানতে চাইলে ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের সিনিয়র নার্স পিশিলা জাগো নিউজকে বলেন, ডেঙ্গু রোগীর প্রতিটি বেডের জন্য একটি করে মশারি দেওয়া হয়। কিন্তু সকাল হলেই তারা সেটি খুলে রাখেন। তাদের বারবার বলার পরও তা একদিকে ঝুলিয়ে রাখেন। কথা না শুনলে আমাদের কিছু করার থাকে না।
তিনি বলেন, তাদের কারণে আমরা, নার্সরা ঝুঁকিতে আছি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই হাসপাতালে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে দুজন ডেঙ্গুরোগী ভর্তি হয়। এরপর মার্চে একজন, এপ্রিলে তিনজন, মে মাসে ছয়জন, জুনে নয়জন, জুলাইয়ে ৫১ জন, আগস্টে ১৩৯ জন এবং সেপ্টেম্বরে ভর্তি হয় ২৫৩ জন। অক্টোবরের ১০ তারিখ পর্যন্ত ভর্তি হয় ৮৭ জন। সব মিলে ৫৫১ জন রোগী ভর্তি হয় এবছর। অনেকে সুস্থ হয়ে রিলিজ পেলেও বর্তমানে ৭৭ জন ভর্তি রয়েছে।
রোগী নিয়ে স্বজনদের সচেতনতাও আছে
জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম জাগো নিউজকে বলেন, হঠাৎ করে সারাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে গেছে। থেমে থেমে বৃষ্টি, জলাবদ্ধতার কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। শীত চলে এলে এর প্রকোপ কমে যাবে। প্রতিদিন যে পরিমাণে হাসপাতালে রোগী আসছে তাতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এটি সামাল দিতে আলাদা দুটি ডেঙ্গু সেল তৈরি করা হয়েছে। ডেঙ্গু রোগীদের আমরা বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে থাকি।
তিনি বলেন, আগের তুলনায় এবার ডেঙ্গু রোগীদের ধরনে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। আগে কারও কারও রক্তক্ষরণ দাঁত, নাক, মুখ দিয়ে হতো। এখন সেটি ফুসফুসের মধ্যে হচ্ছে। এটি হলে তাকে সুস্থ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। অনেকে আক্রান্ত হলে অনেক দেরি করে হাসপাতালে আনায় অবস্থা জটিল হয়ে যায়। সে কারণে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিলে তাকে ডাক্তার দেখাতে হবে।
ডেঙ্গু রোগীরা মশারি ছাড়া থেকে অন্যদের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে, এ বিষয়ে তিনি বলেন, অনেক রোগী দিনের বেলায় মশারি খুলে রাখছে। তাদের বারবার সতর্ক করে দেওয়া হলেও সেটি করছে। এ বিষয়ে আরও কঠোর হতে নির্দেশ দেওয়া হবে।
এমএইচএম/এমএইচআর/এএসএম