নিপাহ ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে পৌনে ১০ লাখ ডলার দেবে সেপি
নিপাহ ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে গবেষণা শুরু করছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)। এ গবেষণা পরিচালনার জন্য নয় লাখ ৮০ হাজার ডলার আর্থিক সহায়তা করবে করবে দ্য কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনস (সেপি)।
গবেষণায় মারাত্মক নিপাহ সংক্রমণ থেকে বেঁচে যাওয়া ৫০ জনের বেশি ব্যক্তি অংশ নেবে। ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষের শরীরের তৈরি হওয়া রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা চিহ্নিত করা হবে। পাশাপাশি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে ভাইরাসটির পরিবর্তন হয় তা জানার চেষ্টা করা হবে। এসব নতুন তথ্য ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা, চিকিত্সা ও ভ্যাকসিনের জন্য টুলস তৈরিতে সাহায্য করবে। গবেষণাটি পরিচালিত হবে বাংলাদেশে। যেখানে প্রতি বছরই নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে।
সেপি এরই মধ্যে মালয়েশিয়ায় ইউনিভার্সিটি অব মালয়ার সঙ্গে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের নিয়ে অনুরূপ কার্যক্রম চালাচ্ছে। আইসিডিডিআর,বির এ গবেষণা নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি করবে ও একই সঙ্গে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাবিষয়ক তথ্য উপাত্ত নথিভুক্ত করবে এবং মালয়েশিয়ার আক্রান্ত ব্যক্তিদের নিপাহ স্ট্রেইনের সঙ্গে তুলনা করা হবে।
এ ভাইরাস সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির পাশাপাশি নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের থেকে প্রাপ্ত বায়োলজিক্যাল উপাদানগুলো নিপাহ ভ্যাকসিনের আসন্ন দ্বিতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করা হবে। ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে এ গবেষণা শুরু হবে। এ গবেষণার টুলস ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মানদণ্ড উন্নয়নে সহায়তা দেবে।
সেপির লক্ষ্যমাত্রা, মহামারী প্রস্তুতি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ঘোষিত ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার নিপাহ ভাইরাসের ভ্যাকসিনের গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য ব্যয় করবে। সেপি এখন পর্যন্ত চারটি সম্ভাব্য নিপাহ ভ্যাকসিনর জন্য এরই মধ্যে ১০০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে একাডেমিয়া ও ইন্ডাস্ট্রি অন্তর্ভুক্ত এইউরো ভ্যাকসিনস অ্যান্ড পাথ, পাবলিক হেলথ ভ্যাকসিন, দি ইউনিভার্সিটি অব টোকিও এবং ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড, এইউরো ভ্যাকসিনস অ্যান্ড পাথ ও পাবলিখ হেলথ ভ্যাকসিনস দ্বারা উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনই বিশ্বের প্রথম যা মানব দেবে (ফেইস ১) ট্রায়াল চলমান।
এ প্রকল্পে সেপির অর্থায়নে ক্লিনিকাল ট্রায়াল ও নতুন নিপাহ বা আসন্ন সংক্রামক রোগের নতুন প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশের স্থানীয় পরীক্ষাগারের সক্ষমতা তৈরিতে সহায়তা করবে। যা শক্তিশালী ও কার্যকর বৈশ্বিক সমন্বয়ের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং প্রসারিত করার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
এ বিষয়ে সেপির গবেষণা ও উন্নয়ন শাখার নির্বাহী পরিচালক ডা. মেলানি স্যাভিল বলেন, চলমান কোভিড-১৯ সংকট থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, যেসব মানুষেরা সংক্রমিত হয়েছে তাদের শরীরে এই ভাইরাস কীভাবে কাজ করে। এ সম্পর্কে গবেষণা অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারে। এ ধরনের তথ্য ভ্যাকসিনের মতো জীবন রক্ষাকারী টুলস তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
তিনি বলেন, বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় বাংলাদেশের বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআর,বির সঙ্গে এই নতুন গবেষণাটি নিপাহ ভ্যাকসিনের উন্নয়নে অগ্রসর হওয়ার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ভবিষ্যৎ ভ্যাকসিনের লাইসেন্স সমর্থন করার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও উপাদান সরবরাহ করবে। মহামারী প্রস্তুতির অগ্রগতি ও এই অত্যন্ত মারাত্মক হুমকির ঝুঁকিতে থাকা অঞ্চলগুলোকে রক্ষা করার জন্য এ গবেষণায় অংশ নেওয়া নিপাহ থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের ধন্যবাদ জানাই।
আইসিডিডিআর,বির নির্বাহী পরিচালক ডা. তাহমিদ আহমেদ বলেন, ভ্যাকসিন গবেষণায় আইসিডিডিআর, বির পাঁচ দশকেরও বেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে। কলেরা, টাইফয়েড, রোটাভাইরাস, হাম, পোলিও, নিউমোনিয়া ডেঙ্গু, এইচপিভিসহ অনেক ভ্যাকসিনের উন্নয়ন ও লাইসেন্স অর্জনে প্রতিষ্ঠাটি বিশেষ অবদান রেখেছে। এছাড়াও উদ্বেগ রয়েছে যে প্যারামিক্সোভাইরাস পরিবারের মধ্যে হতে ভবিষ্যতের একটি ভাইরাসের জন্য বিশ্বকে প্রস্তুত করা উচিত। যা কি না নিপাহ ভাইরাসের মতো মৃত্যুর হার ও ভাইরাল পরিবারের আরেকটি সদস্য হামের মতো সংক্রমিত হতে পরে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে অংশীদারিত্বে আমরা প্রাণী থেকে মানুষে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায় শনাক্তকরণ, রোগের কারণ-অনুসন্ধান সংক্রমণ গতিশীলতা, এবং সংক্রমণ প্রতিরোধের উপায় খুঁজে বের করতে বিশ্বের দীর্ঘতম নিপাহ ভাইরাস সার্ভিল্যান্স পরিচালনা করছি।
তিনি আরও বলেন, আমরা নতুন জ্ঞান ও প্রমাণ সংগ্রহের এই মহান উদ্যোগের অংশ হতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত, যা সম্ভাব্য বৈশ্বিক মহামারি অবস্থা তৈরির ক্ষমতাসম্পন্ন নিপাহ রোগের বিরুদ্ধে একটি ভ্যাকসিন উন্নয়নে সহায়তা করবে এবং অসংখ্য মানুষের জীবন বাঁচাবে।
গবেষণা বিষয়ে ইউকে মেডিসিনস অ্যান্ড হেলথ কেয়ার প্রোডাক্ট রেগুলেটরি এজেন্সির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মার্ক বেইলি বলেন, এ উদ্যোগটি নিপাহ ভ্যাকসিন উন্নয়নের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা ঝুঁকিপূর্ণ জনসংখ্যাকে রক্ষা করবে। আমরা এ মূল প্রকল্পে আইসিডিডিআর,বির সঙ্গে কাজ করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি।
আইসিডিডিআর,বি বলছে, বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছরই নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে। নিপাহ ভাইরাস মানুষকে সংক্রমিত করার জন্য সবচেয়ে মারাত্মক প্যাথোজেনগুলোর মধ্যে একটি। প্যারামিক্সোভাইরাস পরিবারের একজন সদস্য, টেরোপাস বাদুড়ের (ফ্লায়িং ফক্সসেস) মাধ্যমে এই ভাইরাস মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও সংক্রমিত শূকর, সংক্রমিত মানুষ বা বাদুড়ের কামড়ানো ফল বা খেজুরের রসের মতো দূষিত খাবারের মাধ্যমেও তা ছড়িয়ে পড়ে। এ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাদের শ্বসনতন্ত্র ও কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র এই ভাইরাসের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়। এর ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার ৪০ থেকে ৭৫ শতাংশ বলে অনুমান করা হয়।
১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে শনাক্ত হওয়ার পর নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে- বাংলাদেশ, ভারত ও ফিলিপাইনে। আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া ও ওশেনিয়া অঞ্চলজুড়েও টেরোপাস বাদুড় পাওয়া গেছে। যেখানে দুইশ কোটিরও বেশি মানুষের বাসস্থান। ভবিষ্যতে এই ভাইরাস আরও এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
এমইউ/আরএডি/এমএস