যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পরিপাকতন্ত্র বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশি আতিক


প্রকাশিত: ০৪:০৩ পিএম, ০৫ জানুয়ারি ২০১৬

ভাগ্যান্বেষণে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাড়ি জমানো  বাংলাদেশি তরুণ চিকিৎসক এখন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ৫০ পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিশেষজ্ঞদের একজন। দামি রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়ার মতো ডলার পকেটে না থাকায় একসময় সস্ত্রীক নিউইয়র্কের ম্যাকডোনাল্ড রেস্তোরাঁয় সস্তাদামের দুটো ছোট বনরুটি ভাগাভাগি করে খেতেন। সেই তিনি এখন ফ্লোরিডার পটে আঁকা ছবির মতো সুন্দর অরলান্ডো শহরে বাস করেন।

শহরটির চারদিকে সমুদ্রবেষ্টিত। বিশ্ববিখ্যাত ডিজনিওয়ার্ল্ড, ইউনিভার্সেল স্টুডিও, সিওয়ার্ল্ডসহ কি নেই সেই শহরে। ইচ্ছে করলেই এখন তিনি খেতে পারেন যেকোনো দামি রেস্টুরেন্টে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে সুনামের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশি এই চিকিৎসকের নাম অধ্যাপক বিএম আতিকুজ্জামান।

বর্তমানে কলেজ অব মেডিসিন সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটির পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত। স্ত্রী ডা. তাহসিনা ইয়াসমিনও একজন চিকিৎসক।

তারা কেমন আছেন মঙ্গলবার জাগো নিউজের এ প্রতিবেদক এমন প্রশ্ন করলে দু’জনে প্রায় একই সঙ্গে বলে ওঠেন, যখন সস্তা বনরুটি ভাগাভাগি করে খেতাম তখন বলতাম ‘আহ, হাউ হ্যাপি উই আর’। এখনও একই কথা বলি। সুখী ছিলাম, সুখী আছি, ভবিষ্যতেও থাকবো ইনশাল্লাহ।

জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে বিএম আতিকুজ্জামান তার স্মৃতির ঝাঁপি মেলে ধরেন। গন্তব্যহীনভাবে যাত্রা শুরু করে কিভাবে সাফল্যের চূঁড়ায় পৌঁছালেন তার টুকরো টুকরো স্মৃতিচারণ করেন।

সাবেক সরকারি কর্মকর্তা এম আসাদুজ্জামান ও স্কুল শিক্ষিকা খোদেজা জামান দম্পত্তির চার ছেলেমেয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। পৈত্রিক বাড়ি নড়াইল হলেও মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল থেকে এসএসসি, নটরডেমে  থেকে এইচএসসি পাসের পর ২৮তম ব্যাচে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ১৯৯২ সালে এমবিবিএস ও ১৯৯৩ সালে ইন্টার্নশিপ শেষ করেন।

BM-ATIK
ডাক্তারি পাসের পর পরই ১৯৯৪ সালে কেন বিদেশ পাড়ি জমালেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারি চাকরি পাওয়া, স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পেতে গ্রামে ডেপুটেশনে থাকা সর্বোপরি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় ওই সময় চাকরি পাওয়া দুষ্কর হতো। তাই অনেকটা গন্তব্যহীনভাবে দক্ষিণ আফ্রিকাতে পাড়ি জমায়।

তখন বাংলাদেশের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। মেডিকেল কলেজের কয়েকজন সিনিয়র ভাই সেখানে গিয়েছিলেন এ ভরসা থেকে পকেটে মাত্র এক হাজার ৫শ’ ডলার নিয়ে রওয়ানা দেই। তবে এয়ারপোর্টে নানা জেরা ও হয়রানি করে পাঁচ হাজার টাকা উৎকোচ দিয়ে অনুমতি পাওয়ার বিষয়টি আজও পীড়া দেয় বলে জানান তিনি।  
তিন বন্ধুসহ চারজন প্রথমে কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে যান। সেখানে থেকে তানজানিয়ার দারুসসালাম, উগান্ডার কামপালা হয়ে জাম্বিয়ার লুসাকাতে পৌঁছেন। ইচ্ছে ছিল সেখানে কয়েকদিন থেকে তারপর দক্ষিণ আফ্রিকাতে যাবেন। কিন্তু জাম্বিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রেমে পড়েন তিনি।   

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি জানান, জাম্বিয়ার মানুষ ভীষণ শান্তি প্রিয়। ভারতীয় বংশোদ্ভুত বেশ কিছু চিকিৎসক সেখানে ডাক্তারি করছেন। সেখানকার মাজেবোচা শহরে ইন্টারভিউ দিয়ে সরাসরি জেলা হাসপাতালের ইনচার্জ হিসেবে নিয়োগ পাই। এখান থেকেই জীবনের মোড় ঘুরতে শুরু করে।

এসময় তিনি অনুভব করেন নিজ দেশে যতটুকু চিকিৎসাবিদ্যা অর্জন করেছেন তা অতি সামান্য। ভালো চিকিৎসক হতে হলে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। কারণ, সেখানে পশ্চিমা বিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞান ও এ সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণা চলছিল। রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে মানবসেবা করা যায় তিনি তা এখান থেকে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন।

১৯৯৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত চাকরি করে পাড়ি জমান নিউইয়র্কে। সেখানে ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে স্ত্রী তাহমিনা ইয়াসমিনের সঙ্গে পরিচয় ও পরবর্তীতে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন।

ডা. আতিক জানান, যুক্তরাষ্ট্রে মেডিসিন বিষয়ে পড়াশুনা করতে চাইলে ডাক্তারদের মেডিকেল লাইসেন্স এক্সামিনেশনের (এমএলই) প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে আবশ্যিকভাবে পাস করতে হয়। ওই পরীক্ষায় পাস করে নিউইউর্কের প্রাচীন ও প্রথম মেডিকেল কলেজে (লং আইল্যান্ড কলেজ হাসপাতাল) মেডিসিন ট্রেনিং শুরু করেন। কথার ফাঁকে তিনি জানান, কলেজটি  নোবেল পুরস্কার পেয়েছে।

monirujaman
পরবর্তীতে স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কে প্রশিক্ষণ গ্রহণকালে জেরিয়েট্রিক ও পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিশেষজ্ঞ  ডা. ফিল্ড সুজানের সান্নিধ্য পান। এছাড়াও তিনি আমেরিকান কলেজ অব গ্যাস্ট্রোএন্ট্রারোলজির গভর্নর খ্যাত প্রফেসর গ্রসম্যানের কাছে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ পান।   

২০০৪ সালের জুনে সপরিবারে ফ্লোরিডার অরলান্ডোতে পাড়ি জমান। অরলান্ডোতে পাড়ি জমানোর ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শহরটি ছবির মতো সুন্দর। তবে আবহাওয়া বাংলাদেশের মতো।

গত ১২ বছর ধরে কলেজ অব মেডিসিন সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটির পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন। সেখানে শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে পরিপাকতন্ত্র ও লিভার রোগ সম্পর্কে শিক্ষাদান করেন। এ বিষয়ের বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি কয়েকবার পুরস্কৃতও হয়েছেন বলে জানান।

এক সময়ে ভাগ্যান্বেষণে বিদেশে পাড়ি দেয়া, ম্যাকডোনাল্ডে দুটো বনরুটি স্ত্রীর সঙ্গে  ভাগাভাগি করা এই চিকিৎসকের প্রিয় শখ ভ্রমণ। অ্যার্ন্টাটিকা ছাড়া সব মহাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন বলে একগাল হাসলেন তিনি। আরো জানালেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি ছাত্রসংসদে ১৯৮৯, ১৯৯০ ও ১৯৯১ সালে সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। ওই সময় এত বেশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো বলে ছাত্রশিবির তার বিরুদ্ধে মেডিকেল কলেজে শিল্প একাডেমি বানিয়ে ফেলার অভিযোগ তুলেছিল।

ডা. আতিক জানান, সুদূর প্রবাসে থাকলেও দেশের জন্য মন কাঁদে। আর তাইতো প্রতিবছরই দেশে আসেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে পড়াশুনা করায় আসার সময় শিশু বিভাগের শিশুদের জন্য গরম কাপড়-চোপড় নিয়ে আসেন।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিছু কিছু চিকিৎসা যন্ত্রপাতিও সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। এছাড়া নিজ খরচে দু’জন চিকিৎসককে তার কাছে নিয়ে নিজের বাসায় রেখে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন বলেও জানান তিনি।   

এমইউ/এসএইচএস/এএইচ/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।