চিকিৎসক সংকটেও নিয়োগবঞ্চিত বিসিএসে উত্তীর্ণ ১৯১৯ প্রার্থী
অডিও শুনুন
দেশে ১১ হাজার ৩৬৪ চিকিৎসকের পদ শূন্য। করোনা মহামারির এই সময়ে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পূরণ হচ্ছে না এসব পদ। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) পরীক্ষায় (বিসিএস) উত্তীর্ণ প্রার্থীদেরও দেওয়া হচ্ছে না নিয়োগ। এতে হতাশা বাড়ছে বঞ্চিত চিকিৎসকদের মধ্যে।
৪২তম বিসিএসে চার হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশে পিএসসি উল্লেখ করেছে, বাকি ১৯শ ১৯ জনকে উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও পদ স্বল্পতার কারণে সুপারিশ করা যাচ্ছে না।’ অথচ স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ বিভিন্ন সূত্রের দাবি, ওই সুপারিশে চার হাজার নিয়োগ হলেও চিকিৎসকদের আরও ছয় হাজার ৭০৪টি পদ শূন্য থাকে।
এ বিষয়ে পিএসসি বলছে, সরকার যে চাহিদা দেয়, তারা তাই নিয়োগের সুপারিশ করে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলছে, এ বিষয়ে তাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে।
জানা যায়, গেলো দুই বছরে করোনা সংকটে সম্মুখসারির যোদ্ধা চিকিৎসকরাই ছিলেন ত্রাতার ভূমিকায়। অদৃশ্য এই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে প্রয়োজন ছিল চিকিৎসকদের গাইডলাইন। সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও প্রাণপণে লড়াই করে মানুষের পাশে ছিলেন চিকিৎসকরা। ফলে সংকট কাটিয়ে ওঠার দ্বারপ্রান্ত দেশ। কিন্তু জীবনের ঝুঁকি সঙ্গী করে হাসপাতালের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ছুটে বেড়ানো চিকিৎসকদের প্রাপ্তির ঝুলিতে শুধুই হতাশা।
তারা বলছেন, গত দুই বিসিএসে (বিশেষ) উত্তীর্ণ প্রায় আট হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়নি পদ নেই বলে। কিন্তু হাসপাতালে চিকিৎসক নেই। যাদের বয়স আছে, তারা হয়তো পরের বিসিএসে চলে আসে। যাদের বয়স নেই, তাদের জন্য কেবলই হতাশা।
জানা যায়, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২১ এর স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবা সূচকে চিকিৎসক ও জনসংখ্যার অনুপাত (২০১৮) হচ্ছে ১:১৭২৪ অর্থাৎ প্রতি ১৭শ ২৪ জন মানুষের জন্য চিকিৎসক আছেন মাত্র ১ জন!
গত ১৬ নভেম্বর, ২০২০ তারিখে জাতীয় সংসদে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, সারা দেশে চিকিৎসকের ১১ হাজার ৩৬৪টি পদ শূন্য রয়েছে এবং ৬৪ জেলার সবকটিতেই চিকিৎসকের পদ ফাঁকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি তিন হাজার ১৮৫টি পদ ফাঁকা রয়েছে ঢাকায়।
হিসাব করে দেখা যায়, ৩৮তম বিসিএস থেকে ২৯০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ৪২তম বিসিএস (বিশেষ) থেকে চার হাজার চিকিৎসক নিয়োগের অপেক্ষায় আছেন। ৪০তম বিসিএস থেকে ২৬০ জন এবং ৪১তম বিসিএস থেকে আরও ১১০ জন চিকিৎসকের শূন্যপদ পূরণের কার্যক্রম চলমান। এরপরও শূন্য রয়ে গেছে ৬ হাজার ৭০৪ পদ। তবে কোভিড পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘদিন স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকায় বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন পাঁচটি বিসিএস পরীক্ষা ও সুপারিশসংক্রান্ত জটে হিমশিম খাচ্ছে বিধায় আগামী ২-৪ বছরের আগে এসব শূন্যপদ পূরণ অসম্ভব।
সব মিলিয়ে ৪২তম বিসিএস (বিশেষ) এর চার হাজার জন চিকিৎসক নিয়োগ পাওয়ার পরেও বর্তমানে দেশের সরকারি চিকিৎসা সেবাদান কেন্দ্রগুলোতে ছয় হাজার ৭০৪টি পদ শূন্য থাকবে।
এরমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের এইচআরআইএস রিপোর্টের (গত ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ তারিখের) তথ্যানুযায়ী, শুধু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেই চিকিৎসকের পদ শূন্য রয়েছে পাঁচ হাজার ৮৪৮টি। এছাড়া, বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুযায়ী, করোনায় এ পর্যন্ত ১৮৬ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মারা গেছেন। ফলে, কিছুটা হলেও দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকট তৈরি হয়েছে। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক সংকটের কারণে স্বাস্থ্য সেবাদান কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মোশতাক হোসেন ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এম এইচ লেলিনের মতে, করোনার তৃতীয় ঢেউ অক্টোবরে আঘাত হানতে পারে। এটি অত্যন্ত ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। সেজন্য আগে থেকেই আমাদের টিকাদান কর্মসূচি জোরদার করার পাশাপাশি অন্য সব প্রস্তুতি যেমন- অক্সিজেন সংকট নিরসন, হাসপাতালগুলোতে আসন ও আইসিইউ বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর শূন্যপদ পূরণ করতে হবে।
এসব বিবেচনায় ৪২তম বিসিএস (বিশেষ) থেকে উত্তীর্ণ অপেক্ষমাণ এই ১৯শ ১৯ জন চিকিৎসককে নিয়োগ দেওয়া হলে এই সমস্যা এবং সম্ভাব্য সংকট অনেকাংশে লাঘব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ নিয়ে ৪২তম বিসিএসে উত্তীর্ণ ডা. আশরাফুল ইসলাম রবিন জাগো নিউজকে বলেন, মাত্র একটি সিদ্ধান্তের জন্য সংকটে পড়ছে স্বাস্থ্যখাত, পাশাপাশি বঞ্চিত হচ্ছি আমরা প্রায় দুই হাজার চিকিৎসক। যেহেতু আমরা বিসিএসে (লিখিত ও ভাইভা) উত্তীর্ণ, পদও শূন্য আছে অনেক, রাষ্ট্রের এই স্বাস্থ্যখাতের আশু সংকট মোকাবিলা ও আমাদের অনেকের জীবনের নিরাপত্তার জন্য এই নিয়োগ জরুরি। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্ট সবার হস্তক্ষেপ কামনা করি আমরা।
যেহেতু ৪২তম বিসিএসের সুপারিশপ্রাপ্ত চার হাজার জন নিয়োগ দিলে আরও ছয় হাজারের বেশি চিকিৎসকের পদ শূন্য থাকে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আছে দুই হাজার চিকিৎসক, তাদের নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ আছে কী? এমন প্রশ্নের জবাবে পিএসসির চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, সরকার যদি চায় তখন সেটি বিবেচনা করা যাবে। আমাদের যা বলা হয়, যা চাওয়া হয়, সেই সংখ্যা নিয়োগ করার জন্য বিজ্ঞাপন দেই, পরীক্ষা নেই এবং সেই সংখ্যাই সুপারিশ করি। চিকিৎসকদের বেলায়ও আমাদের কাছে যা চাওয়া হয়েছে তা সুপারিশ করেছি।
তিনি বলেন, পাস করলে চাকরি অপরিহার্য বা দিতেই হবে- এমন কোনো বিধান নেই। সব বিসিএসেই অধিক পাস করে, কিন্তু সবাই সুপারিশ পান না। শুধু শুন্যপদের বিপরীতেই সরকারি চাহিদা অনুযায়ী সুপারিশ করা হয়। চিকিৎসকদের ক্ষেত্রেও আমাদের কাছে যা চাহিদা ছিল, আমরা তাই সুপারিশ করেছি। যদি আরও চাহিদা আসে, আমরা তখন দেখবো।
সরকার চাহিদা দেবে কি না বা এদের নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ আছে কি না, এমন প্রশ্নে জবাবে জনপ্রশাসন সচিব কে এম আলী আজম জাগো নিউজকে বলেন, এ বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলতে পারবে। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে আমাদের কাছে কংক্রিট তথ্য আসেনি। এর কোনো অফিসিয়াল বিষয় আমাদের কাছে নেই।
এ বিষয়ে চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী পিএসসিকে দোষারোপ করছেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, পিএসসি বলছে, উত্তীর্ণ কিন্তু পদ নেই। এটাই ঝামেলা সৃষ্টি করেছে। কারণ পিএসসিকে তো বলা হয়েছে, আমার এতজন পদের বিপরীতে আপনি লোক নেন। বলা হয়েছে, চার হাজার নিতে, তাদের তো বলা হয়নি ছয় হাজার নিতে। ঝামেলাটা এখানেই। এগুলো তো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা। টপ মার্ক দেখে আপনি চার হাজার নিয়ে নেবেন, শেষ। আপনি বললেন, ছয় হাজার উত্তীর্ণ, চার হাজার নিলাম আর বাকিগুলো ওয়েটিং। এটাই তো সমস্যা।
এসইউজে/এএ/এমএস