দেশে প্রতিদিন ৪৭ নবজাতকের মৃত্যু
নবজাতকের মৃত্যুহার হ্রাসে বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন করেছে। ‘বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্যজরিপ (বিডিএইচএস) ২০১৪’ এর প্রাপ্ততথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সাল পর্যন্ত নবজাতকের মৃত্যুহারের নিম্নমুখী প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তবে বিডিএইচএস ২০১৭-১৮ সমীক্ষায় দেখা যায়, এই হার ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফিরে আসছে। বাংলাদেশে প্রতি এক হাজার জীবিত নবজাতকের মধ্যে ৩০ জন অকালমৃত্যুর শিকার হয়। এদের মধ্যে ১৯ শতাংশ মারা যায় অকালজাতজন্ম (প্রিম্যাচিওর বার্থ) এবং জন্মকালীন কম ওজনের (লো বার্থ ওয়েট) সম্মিলিত কারণে।
‘বাংলাদেশে অকালজাতজন্ম ও জন্মকালীন কম ওজনের সমস্যা, সমাধান ও উত্তরণের উপায়’ সম্পর্কে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এ তথ্য জানান বক্তারা। বুধবার (৩ ফেব্রুয়ারি) মহাখালীতে আইসিডিডিআরবি কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ সভার আয়োজন করে ইউএসএআইডির অর্থায়নে পরিচালিত আইসিডিডিআরবির রিসার্চ ফর ডিসিশন মেকারস (আরডিএম) প্রকল্প ও ডাটা ফর ইম্প্যাক্ট (ডিফরআই)। সভায় বিশেষজ্ঞ হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নবজাতক স্বাস্থ্যবিষয়ক জাতীয় টেকনিক্যাল ওয়ার্কিং কমিটির চেয়ারম্যান প্রফেসর মোহাম্মাদ শহীদুল্লাহ এবং আইপাস বাংলাদেশের কান্ট্রি প্রধান ডা. সায়েদ রুবায়েত।
অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আইসিডিডিআরবির ম্যাটারনাল অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ ডিভিশনের সিনিয়র ডিরেক্টর ও আরডিএম প্রকল্প প্রধান ডা. শামস এল আরেফিন। মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন আইসিডিডিআরবির অ্যাসোসিয়েট সায়েন্টিস্ট ডা. আহমেদ এহসানুর রহমান। ১৪ জন সাংবাদিক এই সভায় অংশ নেন। এছাড়াও সভায় উপস্থিত ছিলেন ইউএসএইড বাংলাদেশের সিনিয়র মনিটরিং, ইভ্যালুয়েশন অ্যান্ড রিসার্চ অ্যাডভাইজর ডা. কান্তা জামিল।
সভায় বক্তারা জানান, অকালমৃত্যুর অন্যতম কারণ হচ্ছে শিশুর অকালজাতজন্ম (গর্ভে ৩৭ সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার পূর্বে) এবং জন্মকালীন ওজন দুই দশমিক পাঁচ কেজি বা আড়াই হাজার গ্রামের নিচে হওয়া। প্রতি বছর বাংলাদেশে পাঁচ লাখ ৭৩ হাজার নবজাতক প্রিম্যাচিওর অবস্থায় এবং আট লাখ ৩৪ হাজার নবজাতক কম ওজন নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়, এদের মধ্যে এক লাখ ৯২ হাজার নবজাতকের জন্মকালীন ওজন হয় দুই কেজি বা আড়াই হাজার গ্রামের নিচে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে দেশে প্রতিবছর ১৭ হাজার ১০০ নবজাতক এই দুইয়ের সম্মিলিত কারণে (প্রতিদিন গড়ে ৪৬ দশমিক ৮৪ জন) মৃত্যুবরণ করে, এদের মধ্যে ৭২ শতাংশ জন্মের প্রথমদিন পূর্ণ করার আগেই মৃত্যুবরণ করে।
তারা জানান, এই ১৭ হাজার ১০০ নবজাতক মৃত্যুর ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ পরিবার কোনো ধরনের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেন না, অন্যদিকে ৪৩ শতাংশ মৃত্যু ঘটে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সহজে বাস্তবায়নযোগ্য বিভিন্ন পদ্ধতি যেমন অ্যান্টিনেটাল কর্টিকোস্টেরয়েড (এসিএস), ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার (কেএমসি) এবং স্পেশাল কেয়ার নিউবর্ন ইউনিট (স্ক্যানু) ইতোমধ্যেই এই মৃত্যুরোধে কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। তবে নবজাতকের জন্মকালীন ওজন নির্ণয়ের মাধ্যমের তাকে কম ওজনের হিসেবে চিহ্নিত করার যে পদ্ধতি তার প্রস্তুতি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে অপ্রতুল। বাংলাদেশ হেলথ ফ্যাসিলিটি সার্ভে ২০১৭ অনুযায়ী, দেশের মাত্র ৬৯ শতাংশ জেলা হাসপাতাল এবং ৬৫ শতাংশ উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এই ওজন পরিমাপক স্কেল আছে।
দেশের মাত্র ২০০ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কেএমসি সেবাপ্রদানের ব্যবস্থা আছে যেখানে সীমিত সংখ্যক কম ওজনসম্পন্ন নবজাতক সেবা পাচ্ছে। কেএমসি প্রদানের গুণগতমান, ফলো আপ সুবিধার অপর্যাপ্ততা এবং কম সময় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অবস্থানের প্রবণতাও সমীক্ষায় উঠে আসে। ২০২০ সালে মাত্র পাঁচ হাজার ৭৩১ জন নবজাতক কেএমসি সেবা লাভ করে যা সেবা প্রয়োজন এমন নবজাতকের সংখ্যার মাত্র এক শতাংশ।
ডা. এহসান বলেন, যদিও নবজাতকের মৃত্যুরোধে কেএমসি অত্যন্ত উপযোগী, একে একটি কম ব্যয়সাপেক্ষ ও সহজ সমাধান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এই পদ্ধতির সঠিক প্রয়োগের জন্য চাই দীর্ঘ সময় শিশুকে মায়ের ত্বকের সংস্পর্শে রেখে সেবা প্রদান ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ। ফলে আপাতদৃষ্টিতে একে সহজ সমাধান মনে হলেও এই পদ্ধতির বাস্তবায়নে প্রয়োজন আরও বেশি মনোযোগ।
ডা. রুবায়েত বলেন, জীবন রক্ষাকারী সকল পদ্ধতি কম ব্যয়সাপেক্ষ হবে এমনটা ভেবে নেয়া উচিত না, আর কেএমসি তেমনি একটি কার্যকরী পদ্ধতি। বক্তারা আরও বলেন, কোভিড-১৯ এর মতো মহামারির সময়েও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে যে উপযুক্ত সাবধানতা অবলম্বন করে কেএমসি প্রদান করলে নবজাতকের জন্য ঝুঁকি তৈরি হয় না। তাই নবজাতক মৃত্যুরোধেকে এমসিসহ অন্যান্য সেবা সহজলভ্য করার পাশাপাশি এর সুবিধা সম্পর্কে পরিবার ও কমিউনিটিকে অবহিত করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এমইউ/বিএ/এমকেএইচ