ডায়াবেটিস প্রতিরোধে ১৪ বছরেও হয়নি জাতীয় নীতিমালা
দেশে অনুমিত পরিসংখ্যান অনুসারে ৮৩ লাখেরও বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এ সংখ্যার সঙ্গে প্রতি বছর নতুন করে তিন থেকে পাঁচ লাখ নতুন রোগী আক্রান্ত হচ্ছেন। আক্রান্তদের ৫০ শতাংশই জানেন না তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়ে এবং যাদের এখনও ডায়াবেটিস হয়নি তাদের এ রোগ প্রতিরোধে সচেতন করতে ‘প্রিভেনশন পলিসি অ্যান্ড কন্ট্রোল ফর ডায়াবেটিস’ প্রণয়ন জরুরি। কিন্তু দেশে রোগটি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে জাতীয়ভাবে কোনো নীতিমালা নেই। গত ১৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে নীতিমালা প্রণয়নের কথা শোনা গেলেও এখনও সেটি হয়নি। নীতিমালাটি প্রণয়নের দায়িত্ব স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় নাকি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের, তা নিয়ে রশি টানাটানিতে আজও ঝুলে আছে নীতিমালাটি।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় নীতিমালাটি প্রণয়ন করে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভায় উত্থাপনপূর্বক চূড়ান্তভাবে মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদনের জন্য পাঠানোর কথা। মন্ত্রিসভায় পাস হলে সেটি সংসদে পাঠানোর কথা। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সেটি মন্ত্রিসভার বৈঠকে পাঠানো হচ্ছে না!
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির (বাডাস) সভাপতি অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান বলেন, সারা বিশ্বে ডায়াবেটিস এখন মহামারি আকার ধারণ করছে। উন্নত দেশের চেয়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। কায়িক শ্রম কমে যাওয়া, কম হাঁটা, অধিক তেলযুক্ত খাবার ও ফাস্ট ফুড খাওয়া, খেলাধুলা না করা, স্থূল হওয়া, মানসিক চাপ— এসব কারণে ডায়াবেটিসের প্রকোপ বাড়ছে।
তিনি বলেন, ডায়াবেটিস সারাজীবনের রোগ। একবার হলে আর সারে না। তবে, এটি সুনিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে এটি হওয়ার আগেই যেসব কারণে ডায়াবেটিস হয় সে সম্পর্কে দেশের জনগণকে সচেতন করা এবং ডায়াবেটিস হলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার চর্চা অনুশীলনের জন্যও জাতীয়ভাবে নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি।
তিনি আরও বলেন, ২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর ‘ইউএন রেজুলেশন ৬১/২২৫’ শীর্ষক ঘোষণাপত্রে জাতিসংঘের প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রকে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও চিকিৎসার বিষয়ে জাতীয় নীতিমালা প্রণয়নের তাগিদ দেয়া হয়। ২০০৭ সালে বাডাসের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তথা সরকারের কাছে নীতিমালা প্রণয়নের জন্য খসড়া উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু ১৪ বছরেও তা আলোর মুখ দেখেনি। নীতিমালাটি কি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নাকি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রণয়ন করবে তা নিয়েও চলছে নীরব দ্বন্দ্ব!
অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদা খান বলেন, নীতিমালাটি প্রণয়নের সঙ্গে আর্থিক কোনো সংশ্লেষ নেই। এটি প্রণীত হলে ফাস্ট ফুড, মিষ্টি, কোমলপানীয়সহ যেসব খাবার গ্রহণের কারণে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি থাকে তা থাকবে না। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, তাদের প্রস্তাবিত খসড়ায় ফাস্ট ফুডের কোন খাবারের কত মূল্য (ফুড ভ্যালু) রয়েছে তা খাবারের প্যাকেটে উল্লেখ করতে হবে বলে বলা হয়েছিল। এতে মানুষ এ ধরনের খাবার কতটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তা বুঝতে পারবে এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
জাতীয়ভাবে নীতিমালাটি প্রণীত না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে এক কথায় তিনি বলেন, ‘নীতিমালাটি প্রণীত হলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এ কারণে এটি প্রণয়নে টালবাহানা চলছে।
বাডাস মহাসচিব মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন জানান, খসড়া নীতিমালায় তারা স্কুল-কলেজসহ প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ডায়াবেটিস প্রতিরোধী জোরালো কর্মকাণ্ড গ্রহণ, শহরের ফুটপাতগুলো হাঁটার উপযোগী রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, হাউজিং কোম্পানিগুলো তাদের প্রকল্পে যাতে মানুষের স্বাচ্ছন্দ্য মতো হাঁটাচলা করতে পারে সেই ব্যবস্থা রাখতে তাগিদ, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকে ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য রচনা অন্তর্ভুক্তকরণ, ফাস্ট ফুডসহ অন্যান্য উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবারের প্যাকেটে ক্যালরির পরিমাণ ও উপাদান লিখে দেয়া বাধ্যতামূলক, ধূমপান প্রতিরোধ কর্মকাণ্ড জোরদার করা, ঢাকা শহরে কয়েকটি স্কুলের জন্য হলেও একটি খেলার মাঠের ব্যবস্থা করার ওপর গুরুত্ব প্রদানের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়। কিন্তু এখনও তা আলোর মুখ দেখেনি।
এমইউ/এমএআর/জেআইএম