মানুষের দেহের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা কমে যাচ্ছে
দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট। তাপমাত্রা এর বেশি হলে আমরা সেটাকে বলি জ্বর। তবে এক গবেষণা বলছে, এতদিন আমরা যেটাকে দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা বলতাম, এখন আর তা স্বাভাবিক থাকছে না। গত ২০০ বছরে সেই স্বাভাবিকতা নেমে ৯৭.৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটে দাঁড়িয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের দেহের তাপমাত্রাও কমেছে। তবে সেই হার পুরুষের তুলনায় সামান্য কম। নারীদের শরীরের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা এখন ৯৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট।
যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অব মেডিসিন’র সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৬০ বছর বা তার কিছুটা বেশি সময় আগে আমাদের দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা যা ছিল, সেই উষ্ণতা আমরা ধরে রাখতে পারিনি। দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা কমে গেছে ১ ডিগ্রি ফারেনহাইটেরও বেশি।
আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘ইলাইফ’-এর সাম্প্রতিক সংখ্যায় গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষকদলের অন্যতম সদস্য স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অব মেডিসিন’র অধ্যাপক অনুপম মাজি। তিনি বলেন, আমাদের দেহের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রার এই অবনমন হঠাৎই হয়নি। তা ধাপে ধাপে নেমেছে।
রসিকতার সুরে তিনি বলেছেন, ‘দেহের তাপমাত্রার পারদ এখন ৯৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছুঁলেই আমি আপনি অফিস থেকে একটা ক্যাজুয়াল লিভ নিয়ে নিতে পারি!’
প্রবীণদের তুলনায় তরুণ প্রজন্মের শরীরের তাপমাত্রা তুলনামূলক বেশি জানিয়ে এই গবেষক বলেন, ‘১৬০ বছর আগে জার্মান চিকিৎসক ভান্ডারলিচ যখন তাপমাত্রা পরিমাপের হিসাবটা কষেছিলেন, তখন আমাদের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৩৮ বছর। যক্ষা থেকে সিফিলিস এবং নানা রকমের প্রদাহে তখন প্রায়ই মৃত্যুর ঘটনা ঘটত। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেহের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা কমে যাওয়া আর প্রদাহে আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সেই তাপমাত্রা বাড়ার ঘটনার রেকর্ড থেকেই বোঝা যাচ্ছে, কেন তরুণ প্রজন্মের গা প্রবীণদের চেয়ে তুলনায় বেশি গরম। বিভিন্ন রকমের প্রদাহে বেশি আক্রান্ত হয় তরুণ প্রজন্মই। তার ফলে তাদের দেহের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা বাড়ে।’
‘সেই তাপমাত্রা কমে যায় প্রদাহ কমানোর ওষুধ (‘অ্যাসপিরিনের মতো ‘অ্যান্টি-পাইরেটিক ড্রাগ’) খাওয়ায়। আর সেটা তরুণদের ক্ষেত্রেই ঘনঘন হয়। দুশো বছর আগে এই সব ওষুধ ছিল না। তাই তার যথেচ্ছ ব্যবহারও ছিল অসম্ভব। ফলে, সেই সময় কোনো তরুণের দেহের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা এখনকার চেয়ে বেশি ছিল’-যোগ করেন অধ্যাপক অনুপম মাজি।
অধ্যাপক মাজু বলছেন, ‘আমাদের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া ও বিপাক প্রক্রিয়ার হারের তারতম্যের কারণেও দেহের তাপমাত্রার হেরফের হয়। ওই প্রক্রিয়াগুলো আমাদের দেহের তাপমাত্রা বাড়ায়। দৌড়ালে, ব্যায়াম করলে, পরিশ্রম করলে যেগুলোর হার বাড়ে। আগেকার মানুষ অনেক বেশি পরিশ্রম করতেন। ফলে, তাদের বিপাক ও অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার হার ছিল অনেক বেশি। তাই তাদের দেহের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রাও ছিল বেশি। কিন্তু আমাদের জীবন এখন উত্তরোত্তর হয়ে পড়ছে পরিশ্রমবিহীন-আয়েশি। যন্ত্রনির্ভর আধুনিকতার ফলে আমরা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছি।’
স্বাভাবিক তাপমাত্রার ৯৮.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট অঙ্কটি এল যেভাবে
কলকাতার বিশিষ্ট হেমাটোলজিস্ট সুদীপ্তশেখর দাস। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৮৫১ সালে আমাদের দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা কত জানতে ২৫ হাজার রোগীর তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। তারপর তার গড় বের করে আসে ৯৮.৬ ডিগ্রি। তখনই বলা হয়েছিল, এটা আমাদের দেহের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা। যার অর্থ, তার সামান্য কিছু বেশি হতে পারে। আবার ততটাই সামান্য কমও হতে পারে। তবে দুটিকে যোগ করে দুই দিয়ে ভাগ করলে তার মান হবেই হবে ৯৮.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।’
বিভ্রান্তির জবাব দিয়েছেন কলকাতার বিশিষ্ট হেমাটোলজিস্ট শুভাশিস চক্রবর্তী। এ বিষয়ে তার বক্তব্য, ‘আমরা গড় শব্দটিকে বেমালুম ভুলে গেলাম। বিশ্বাস করতে শুরু করলাম ৯৮.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইটই দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা। এইখানেই ভুল হয়ে গেল আমাদের। যদিও অনেক দিন ধরেই চিকিৎসকদের মধ্যে সংশয় দেখা গিয়েছিল, মানবদেহের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রাও কি সত্যি সত্যি এটা কি না?’
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেডিসিনের গবেষণায় সেই সন্দেহ, সংশয়ের নিরসন হলো মনে করছেন অনেক চিকিৎসকই।
এ বিষয়ে সুদীপ্ত ও শুভাশিস দুজনেরই বক্তব্য, ‘স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক গবেষণার অভিনবত্ব তারা দেহের তাপমাত্রা মাপার সবকটি পদ্ধতি ও গত দুই শতাব্দীতে তার যাবতীয় বিবর্তনের বিষয়কে মাথায় রেখেছে। গবেষকরা সেই তাপমাত্রা রেকর্ড করেছেন ১৮৬২ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত। এজন্য ৬ লাখ ৭৭ হাজার মানুষের দেহের তাপমাত্রার রেকর্ড নেয়া হয়েছে। যা ১৬০ বছর আগে জার্মান চিকিৎসকের নেয়া নমুনা-সংখ্যার (২৫ হাজার) প্রায় ২৭ গুণ। ফলে, এই গবেষণার ফলাফল অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য।’
গবেষক অনুপম মাজি বলেন, তাদের গবেষণায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। সেগুলো হলো-
প্রথমত, দেখা গেছে, বিশ্রামরত অবস্থায় থাকা কোনো তরুণের দেহের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা কোনো প্রবীণের (৫০-এর বেশি বয়স) চেয়ে বেশি।
দ্বিতীয়ত, নারীদের দেহের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা পুরুষের তুলনায় সামান্য বেশি।
তৃতীয়ত, দুপুরের দিকে আমাদের দেহের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা কিছুটা বেড়ে যায়। সেটা পুরুষ ও নারী-দুজনের ক্ষেত্রেই সত্য।
গবেষকরা বলছেন, এই হারে দেহের তাপমাত্রার পারদ নামতে থাকলে আর সাড়ে ১৪ হাজার বছর পর আমাদের দেহের তাপমাত্রা হতে পারে শূন্য! অন্তত গাণিতিক হিসাব তাই বলে।
এসআর/পিআর