মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ : মন্ত্রী-কর্মকর্তা-গণমাধ্যমকর্মী তুমুল বাহাস

মনিরুজ্জামান উজ্জ্বল
মনিরুজ্জামান উজ্জ্বল মনিরুজ্জামান উজ্জ্বল , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০৭:৩৫ পিএম, ২০ জুন ২০১৯

রাজধানীর ফার্মেসিতে শতকরা ৯৩ ভাগ মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি হচ্ছে এটা ‘টোটালি ভুল কথা’ বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক। তিনি বলেন, ফার্মেসিতে ওষুধ প্রতিদিনই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়। সে ওষুধগুলো যথাযথ জায়গায় রাখা হয়। তার একটি নীতিমালাও রয়েছে এবং সেখানে লেখা থাকে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রির জন্য নয়। মেয়াদোত্তীর্ণ কোনো ওষুধ সেলফে থাকতে পারবে না এ বিষয়ে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর প্রতিনিয়ত মনিটরিং করে এবং যথাযথ ব্যবস্থাও নেয়। তবে জনগুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি নিয়ে অন্য একদিন পৃথকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত ব্যাখা দেয়া হবে বলে জানান তিনি।

বৃহস্পতিবার দুপুরে সচিবালয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ভিটামিন এ ক্যাম্পেইন দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সম্প্রতি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মোবাইল অভিযানে শতকরা ৯৩ ভাগ ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রয়েছে- তা বিক্রি হচ্ছে এবং সেই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের নির্দেশনা-সংক্রান্ত বিষয়ে গণমাধ্যম কর্মীদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ সব কথা বলেন।

এ প্রসঙ্গটি নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য সচিব ও ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালকের সঙ্গে গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে তুমুল বাহাস হয়।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী সংক্ষিপ্তভাবে কথা বলার পর ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবেদন দেখিয়ে বলেন, প্রকাশিত প্রতিবেদনটির শিরোনামে বলা হয়েছে রাজধানীর ৯৩ ভাগ ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ। অথচ ভেতরে লেখা হচ্ছে রাজধানীর ৯৩ ভাগ ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। এ কথা বলার পর গণমাধ্যমকর্মীরা প্রতিবাদ জানিয়ে তাদের ব্যাখা দেয়ার চেষ্টা করলে হইচই ও হট্টগোল শুরু হয়।

এ সময় স্বাস্থ্য সচিব আসাদুজ্জামান বলেন, কথার কথা বলি ১০০ ভাগ দোকানেই মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ থাকতে পারে। কারণ ওষুধের মেয়াদটা কন্টিনিউয়াস। যদি পত্রিকায় লেখা হতো ১০০ ভাগ ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রয়েছে তা হলে তা ভুল লেখা হয়েছে বলা হতো না। যখনই কোনো ওষুধ মেয়াদোত্তীর্ণ হয় সেটা আলাদা সরিয়ে রেখে তা সংশ্লিষ্ট ওষুধ কোম্পানির কাছে ফার্মেসি থেকে ফেরত দিয়ে রিপ্লেস দেয়া হয়। কিন্তু ১০০ ভাগ ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি হচ্ছে বলা হলে তা মারাত্মক, এটা ক্রিমিনাল অফেন্স।

এ সময় একজন সাংবাদিক প্রশ্ন রাখেন ফার্মেসিতে যে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি হচ্ছে না সেটা কি সচিব মহোদয় বলতে পারবেন? এ সময় সচিব পাল্টা বলেন, আমি যদি বলি আপনার কাছে কী প্রমাণ আছে যে বিক্রি হচ্ছে?

এ সময় ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান বলেন, ওষুধ এমন একটা জিনিস আপনি কিন্তু যেখানে সেখানে ফেলতে পারবেন না। তাহলে ফার্মেসিতে যে ওষুধ মেয়াদোত্তীর্ণ হচ্ছে তা কি রাস্তায় ফেলে দেবে? তাহলে তো পরিবেশ দূষিত হবে। এন্টিবায়োটিক ওষুধ বাইরে ফেললে তো আরও মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।

তিনি বলেন, প্রচলিত নিয়ম হলো ফার্মেসিতে কোনো ওষুধ মেয়াদোত্তীর্ণ হলে তা একটি নির্দিষ্ট কনটেইনারে রাখা হয় এবং সেখানে লেখা থাকে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রির জন্য নয়। সেখানে রাখা ওষুধগুলো কোম্পানি রিপ্লেস করে।

এ সময় এক গণমাধ্যমকর্মী বলেন, তাহলে কী আপনি বলতে চান ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি হচ্ছে না? এ সময় গণমাধ্যমকর্মীরা বলেন, আপনি যেভাবে বলছেন তাতে ফার্মেসিগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রাখতে উৎসাহিত হবে। আপনি বলছেন, ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ নির্দিষ্ট কনটেইনারে পৃথক রাখা হয় এবং সেখানে বিক্রির জন্য নয় লেখা থাকে। তাহলে চলুন এখনই আমরা মন্ত্রী, সচিব ও আপনাকে নিয়ে রাজধানীর ১০টি ওষুধের ফার্মেসিতে গিয়ে দেখি কয়টাতে আপনার কথা অনুসারে কন্টেইনারে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রয়েছে।

এ সময় মহাপরিচালক বলেন, এটা নতুন কোনো ইস্যু নয়। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর ২০১৫ সাল থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি বন্ধে কার্যক্রম চলছে। তিনি জানান, গত ছয় মাসে দেশের বিভিন্ন জেলায় ওষুধের বিষয়ে ৩৭০টি মামলা করা হয় এবং ৫৮ লাখেরও বেশি টাকা জরিমানা করা হয়। বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ফার্মেসিতে ওষুধ কীভাবে রাখতে হবে তা বলা হয়েছে এবং জনগণ কীভাবে সচেতন হবে তা বলা হয়। প্রতিনিয়তই আমরা কার্যক্রম পরিচালনা করছি।

তিনি বলেন, দেশে ১ লাখ ৩০ হাজার লাইসেন্সপ্রাপ্ত ফার্মেসি রয়েছে। আমি বলছি না যে ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ একেবারেই বিক্রি হচ্ছে না। এ ব্যাপারে আদালতের একটি রায় ও নির্দেশনা রয়েছে। আমরা এটি হাতে পাইনি। তবে আমরা আদালতের নির্দেশ শতভাগ পালন করবো।

তিনি আরও বলেন, আমরা কিন্তু বসে নেই। আমরা কাজ করছি। আমরা নকল, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা ও ব্যবস্থা গ্রহণ করছি এবং অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের দোকান সিলগালা করছি।

তিনি বলেন, ফার্মেসির সেলফে যেন শতকরা ১ ভাগ ওষুধও না থাকে সেটা নিশ্চিত করতে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে ও হবে। সবাই মিলে কাজ করলে নকল, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি বন্ধ হবে।

এ সময় গণমাধ্যমকর্মীদের একজন প্রশ্ন রাখেন রাজধানীসহ সারাদেশে ফার্মেসি পরিচালনা করতে হলে ড্রাগ লাইসেন্সের প্রয়োজন হয়। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর লাইসেন্স দেয়ার আগে ফার্মাসিস্ট আছে কিনা তা দেখে। তাহলে সারাদেশে পাড়া-মহল্লায় অলিগলিতে ফার্মাসিস্ট ছাড়াও ভুঁড়িভুঁড়ি ফার্মেসি কীভাবে চলছে?

জবাবে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক জানান, ফার্মেসিতে তিন ক্যাটাগরি (এ, বি ও সি) গ্রাজুয়েট, ডিপ্লোমা ও তিন মাস মেয়াদি কোর্স করা ফার্মাসিস্ট থাকতে হয়। দেশের বেশিরভাগ ফার্মেসি তিন মাস মেয়াদে কোর্স করা ‘সি’ ফার্মাসিস্ট দ্বারা পরিচালিত হয়। নথিপত্র অনুসারে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ফার্মেসির চেয়ে ‘সি’ ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্ট।

এ সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, জনগণের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে এমন কোনো ওষুধ ফার্মেসিতে বিক্রি করতে দেয়া হবে না। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রির ব্যাপারে ব্যবস্থা নিচ্ছি, এখন আরও সচেতন হয়েছি, আরও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। জনগণের স্বাস্থ্য নিয়ে কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেবো না।

তিনি আরও বলেন, এ ব্যাপারে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিকে সময়মতো মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ফার্মেসি থেকে তুলে নেয়া ও ফার্মেসি কাউন্সিলকে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চিঠি দেয়া হয়েছে।

তিনি জনসাধারণকেও সচেতন হয়ে ওষুধ কেনার সময় মেয়াদের তারিখ দেখে কিনতে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, কোনো ব্যক্তি যদি ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের খোঁজ পান তাহলে যেন ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরকে ইনফর্ম করেন।

মন্ত্রী বলেন, কেউ গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবে না ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ একেবারেই বিক্রি হচ্ছে না কিংবা কত শতাংশ বিক্রি হচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

এমইউ/এসএইচএস/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।