‘বাংলাদেশে বললো কিডনি শেষ, ভারতে বললো ফ্রেশ’

সায়েম সাবু
সায়েম সাবু সায়েম সাবু , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৪৬ পিএম, ১৩ মার্চ ২০১৯

রোগ আর চিকিৎসার ব্যবস্থাপনা নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার পার্থক্য তুলনা করে ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতার কথা জানান মেহেদী হাসান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে বলা হলো, আমার কিডনি শেষ অথচ ভারতের চিকিৎসকরা বললেন, না ফ্রেশ আছে।’

সম্প্রতি কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা করাতে গিয়ে বিচিত্র এ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন মেহেদী হাসান। তিনি ক্যান্সারের মতো জটিল রোগেও আক্রান্ত হয়েছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ১৫তম ব্যাচের এ শিক্ষার্থী মেলানোমা নামক স্কিন ক্যান্সারে আক্রান্ত।

ভারতের চেন্নাইয়ের অ্যাপোলো ক্যান্সার হাসপাতালে চিকিৎসক পি ভেনকেটের তত্ত্বাবধানে আক্রান্ত আঙুল কেটে ফেলা হয় মেহেদীর। বর্তমানে তিনি ওই চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে আছেন এবং প্রতি ছয় মাস অন্তর চেন্নাইয়ের ওই হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেন।

ক্যানসারে আক্রান্ত মেহেদীর শরীরে কিছুদিন আগে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কোমরের পেছনে ব্যথা অনুভবের পাশাপাশি মুখমণ্ডলসহ শরীর ফুলে যায়। প্রাথমিক পরীক্ষাতে কিডনিতে সমস্যার কথা জানান চিকিৎসক। এরপর বিআরবি হাসাপাতালের কিডনি বিশেষজ্ঞ ডা. এম এ সামাদকে দেখালে তিনি অনেকগুলো পরীক্ষা দেন। শ্যামলীর ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিকে পরীক্ষা করিয়ে ডা. সামাদের কাছে গেলে তিনি প্রেসক্রিপশনে লেখেন, ‘ক্রনিক্যাল কিডনি ডিজিস (সিকেডি), স্টেজ- ৩’; যা মারাত্মক পর্যায় বলে বিবেচিত। এ সময় তিনি বেশকিছু ওষুধ লিখে দেন।

এরপরের ঘটনা ভিন্ন। রোগ নিয়ে সন্দেহ জেঁকে বসলে মেহেদী ভারতের কলকাতার একটি কিডনি হাসপাতালে ডা. হিমাংশু নগরকে দেখাতে যান। আগের পরীক্ষা দেখার পাশাপাশি তিনিও বেশকিছু নতুন পরীক্ষা দেন। পরীক্ষাতে কিডনির সব বিষয়ে নরমাল রিপোর্ট আসে। তবে এ সময় খাবারের ব্যাপারে কিছু পরামর্শ দেয়া হয় মেহেদীকে। কলকাতা থেকে চিকিৎসা নেয়ার দুই মাস পর (২ মার্চ ২০১৯) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা. এম এ সামাদের দেয়া আগের সব পরীক্ষা করান। এখানকার পরীক্ষাতেও সবকিছু নরমাল আসে এবং মেহেদীর কিডনি নিয়ে শতভাগ সন্তোষ প্রকাশ করেন চিকিৎসকরা।

এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মেহেদী হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশের ডাক্তাররা বললেন, আমার কিডনি শেষ অথচ ভারতে ডাক্তাররা বললেন ফ্রেশ। আজব ঘটনা!’ তিনি বলেন, ‘ডা. সামাদকে দেখানোর পর কী-যে মানসিক যন্ত্রণায় ছিলাম তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। একই রোগে দুই ধরনের রোগনির্ণয়ে আমি রীতিমতো হতাশ হয়েছি। ভারতে চিকিৎসা নেয়ার অভিজ্ঞতা আছে বলে আমি ভালোটাই পেয়েছি। আর যারা নিরীহ, অশিক্ষিত তাদের বেলায় কী দশা হতো! মূলত, কিছু চিকিৎসকের অতিলোভের কারণে এ দেশের মানুষের বিশ্বাস, আস্থা কমছে।’

নিজের ক্যানসারের চিকিৎসার বিষয়ে আরও ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন মেহেদী। দুই বছর আগের কথা। ডান হাতের একটি আঙুলের নখে অস্বাভাবিক দাগ দেখা দেয়। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আবিদা সুলতানাকে দেখানো হয়। তিনি আঙুলে বায়োপসি করতে বলেন। বায়োপসিতে মেলানোমা ধরা পড়ে। তখনও মেহেদী বুঝতে পারেননি মেলানোমা আসলে কী?

পরীক্ষার পর ডা. আবিদা বলেন, ‘সার্জারি করাতে হবে।’ তিনি মেহেদীকে সার্জারি ডিপার্টমেন্টে পাঠান। সেখানকার চিকিৎসকরা গোটা আঙুল কেটে ফেলার পরামর্শ দেন এবং বলেন, ‘এটা ভয়াবহ স্কিন ক্যানসার।’

এ নিয়ে মেহেদী তার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেন, ‘এ সময় আমি রীতিমতো দিশেহারা হয়ে পড়ি। এরপর বিখ্যাত স্কিন বিশেষজ্ঞ ডা. এম ইউ কবির চৌধুরীকে দেখাই। তিনি আমার আঙুলের নখটি তুলে ফেলেন এবং তা পরীক্ষা করতে পাঠান। অথচ সেখানে কোনো রোগ ধরা পড়লো না। এরপর ডা. কবির চৌধুরী রিভিউ চেয়ে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিঠি পাঠান। এবার সেখানে মেলানোমা ক্যানসার ধরা পড়ে। এরপর তিনি ক্যানসার বিশেষজ্ঞকে দেখাতে বলেন।’

ঘটনার বর্ণনায় মেহেদী বলেন, ‘কবির চৌধুরীর পরামর্শে ল্যাবএইড হাসাপাতালে ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডা. মোফাজ্জেল হোসেনকে দেখাই। তিনি কিছু পরীক্ষা ভারত থেকে করে আনতে বলেন। এরপর ভারতের চেন্নাইয়ের অ্যাপোলো ক্যানসার হাসপাতালে অপারেশন করাই। এক মাস চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরি, অনেকটা ভালো হই।’

‘ভারত থেকে আসার পর অপারেশন করা জায়গায় ফের ইনফেকশন শুরু হয়। এবার ঢাকা মেডিকেলের (ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) সার্জন ডা. নাসির উদ্দিনকে দেখাই। কাটা আঙুল দেখে তিনি বলেন, ‘অপারেশনের জায়গায় ব্লাড সারকুলেশন নাই। এটা সারতে দুটা পদ্ধতি আছে। আঙুল কেটে ছোট করতে হবে অথবা চামড়া ছিদ্র করে আঙুল ২১ দিন পেটের মধ্যে রেখে দিতে হবে।’

‘টিস্যু জন্মালে সেখান থেকে অপারেশন করে আঙুল বের করে আনতে হবে।’ আমি তার কোনো পরামর্শ না মেনে টানা ২০ দিন ড্রেসিং করাতে থাকলাম অন্য এক চিকিৎসকের কাছে। আঙুল ভালো হয়ে গেল- বলেন মেহেদী।

পরের ঘটনা প্রসঙ্গে মেহেদী বলেন, ‘ওই ঘটনার চার মাস পর ফের শরীরে সমস্যা দেখা দেয়। এ সময় ডা. এ এফ এম আনোয়ার হোসেনকে (অনকোলজি, ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট) দেখাই। তিনি কিছু পরীক্ষা দেন। পরীক্ষার পর রিপোর্ট দেখে তিনি সঙ্গে সঙ্গে মেডিকেল বোর্ড গঠন করেন। ফুসফুস, লিভার মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে তারা অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নেন।’

‘তবে সেই মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্ত না মেনে ফের চেন্নাইয়ে অ্যাপোলো হাসপাতালে গিয়ে পরীক্ষা করি। পরীক্ষার ফলাফল দেখে সেখানকার চিকিৎসকরা আমাকে পুরোপুরি সুস্থ দাবি করেন এবং এখন পর্যন্ত আমি শারীরিকভাবে সুস্থ আছি’- বলেন মেহেদী।

এএসএস/এসআর/এমএআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।