জরায়ু মুখ ও স্তন ক্যান্সারে বছরে ১৪ হাজার মহিলার মৃত্যু
প্রতি বছর জরায়ু মুখ ও স্তন ক্যান্সারে নতুনভাবে আক্রান্ত হয় ২৬ হাজার ৭ শত ৯২ জন। এর মধ্যে ১১ হাজার ৯ শত ৫৬ জন মহিলা জরায়ু-মুখ ক্যান্সারে এবং ১৪ হাজার ৮ শত ৩৬ জন মহিলা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে মারা যায় প্রায় ১৪ হাজার। মোট মৃতের মধ্যে ৬ হাজার ৫ শত ৮২ জন মহিলা জরায়ু মুখ ক্যান্সারে এবং ৭ হাজার ১ শত ৪২ জন মহিলা স্তন ক্যান্সারে মারা যায়।
দেশের একমাত্র মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩২ লাখ ভায়া ও সিবিই স্ক্রিনিং পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে ১৬ লাখ ৪৭ হাজার ৩৮০ জন মহিলার ভায়া স্ক্রিনিং করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৫ লাখ ৪৪ হাজার ২৮৬ জন মহিলার সিবিই স্ক্রিনিং সম্পন্ন করা হয়েছে। পজিটিভ প্রায় ১ লাখ, এর মধ্যে জরায়ু মুখ ক্যান্সার নির্ণয়ের পরীক্ষায় ৭৫ হাজার ২২৭ জন মহিলার ভায়া পজিটিভ ও স্তন ক্যান্সার নির্ণয়ের পরীক্ষায় ২১ হাজার ২৫০ মহিলার সিবিই পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে। ২৩ হাজার ৫৮৮ জন মহিলা বিএসএমএমইউ এর অবস অ্যান্ড গাইনি বিভাগ ও সার্জারি বিভাগ হতে কল্পোস্কোপি পরীক্ষাসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করেছেন।
দেশে তৃণমূল পর্যায়ে জরায়ু মুখ ও স্তন ক্যান্সার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় পরিচালিত বিএসএমএমইউ এর ‘জরায়ু মুখ ও স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং ও প্রশিক্ষণের জন্য জাতীয় কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্প’এর উদ্যোগে মঙ্গলবার প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনার লক্ষ্যে আয়োজিত ডেসিমিনেশন সেমিনার ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়।
ভায়া ও সিবিই স্ক্রিনিংসহ জরায়ু মুখ ক্যান্সার ও স্তন ক্যান্সার নির্ণয়সহ চিকিৎসা সেবায় অবদান ও ভূমিকা রাখায় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি, পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শিকা, সিভিল সার্জন, উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, কল্পোস্কপিস্ট ও সিনিয়র স্টাফ নার্সদের পুরস্কার প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপি।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিএসএমএমইউ ভিসি অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান। বিশেষ অতিথি হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব বদরুন্নেসা, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদফতরের মহাপরিচালক তন্দ্রা শিকদার। অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন প্রোভিসি (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ সিকদার, প্রোভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আলী আসগর মোড়ল। স্বাগত বক্তব্য রাখেন অবস এন্ড গাইনি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. পারভীন ফাতেমা।
বাংলাদেশে জরায় মুখ ও স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং ও প্রতিরোধ কার্যক্রম উপস্থাপন করেন অধ্যাপক ডা. আশরাফুন্নেসা। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ও সার্জারি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. ছয়েফ উদ্দিন আহমেদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার, বিভাগীয় চেয়ারম্যান, শিক্ষক চিকিৎসক ও কর্মকর্তাসহ সেমিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনষ্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক, গাইনি ও সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, বিভিন্ন জেলার সিভিল সার্জন, ইউএইচঅ্যান্ডএফপিও ও স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও কর্মকর্তা। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, ইউএনএফপিএ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপি বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বে যতগুলো পুরস্কার পেয়েছে তার মধ্যে স্বাস্থ্যখাতের অবদান সবচেয়ে বেশি। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, এখন প্রয়োজন গুণগত মান বৃদ্ধির। তিনি বলেন, ভেজাল খাবার, শস্য উৎপাদনে কীটনাশকের ব্যবহার, পরিবেশ দূষণ, ধূমপানসহ নানা কারণে মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। জরায়ু ও স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অনেক মা-বোন মারা যান, তারা জানেনই না যে তাদের জরায়ু বা স্তনে ক্যান্সার হয়েছে। এজন্য এ প্রাণঘাতী রোগের বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টিসহ প্রতিরোধের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। দেশের সব উপজেলায় যাতে মা-বোনেরা জরায়ু ও স্তন ক্যান্সার নির্ণয়ের বিশেষ করে স্ক্রিনিং- এর সুবিধা পান তা নিশ্চিত করা হবে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হবে।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, ক্যান্সারের প্রকোপ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে যা সত্যিই উদ্বেগজনক। জরায়ু মুখ ও স্তন ক্যান্সারসহ সব ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, অনলাইন সংবাদপত্রসহ গণমাধ্যমের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। যে কোনো ধরনের ক্যান্সার আগে ভাগে চিহ্নিত হলে তা নিরাময়, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ করা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা সব রোগীর সেবা নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া চিকিৎসক, নার্সসহ চিকিৎসাসেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সাপোর্টিং স্টাফ যেন কর্মস্থলে বিনা কারণে অনুপস্থিত না থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে।
সেমিনারে জানানো হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের দরিদ্র নারীদের জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচির মাধ্যমে সেবা প্রদানসহ চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা রয়েছে। সরকারি হাসপাতালসমূহে এ জাতীয় সেবা প্রবর্তন, জনসচেনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম এবং ক্যান্সার আক্রান্ত মহিলাদের রেফারাল পদ্ধতি, ফলোআপ ও চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে। দেশের ১৮০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচি সম্প্রসারিত করা হয়েছে। জেলা হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ সেবা শক্তিশালী করা হয়েছে। ভায়া ও সিবিই ক্যাম্প পরিচালনা করা হচ্ছে। এ সংক্রান্ত সেবা প্রণয়নে সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসক ও নার্সকে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। দেশের প্রায় ৪১১০টি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে (মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে ও নির্বাচিত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স) জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে এবং ১৪টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এমইউ/ওআর/এমএস