বৃষ্টি কামনায় নানা উপাচার

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ সালাহ উদ্দিন মাহমুদ , লেখক ও সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৯:৫৬ এএম, ২৫ এপ্রিল ২০১৬

চৈত্র ও বৈশাখ মাসে চারিদিকে খাঁ-খাঁ রোদ। মাঠ-ঘাট ফেটে চৌচির। কোথাও স্বস্তি নেই। শরীর গরম, মেজাজ গরম- তাই মন-মানসিকতাও চরম। এত এত গরমের চরম আতিশয্যের মাঝেও বাঙালি খোঁজে উৎসব। কামনা করে বৃষ্টি, শীতল অনুভূতি। আর সেই কামনাই রূপ নেয় উৎসবে। পালিত হতে থাকে যুগ যুগ ধরে।

চৈত্র ও বৈশাখের কাঠফাটা রোদের সময় বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাল-ডাল তোলে কিশোর-কিশোরীরা। সাথে গানও গায়। টিনের চালে পানি ছুড়ে মেরে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানো হয়। একটা উৎসবমুখর পরিবেশ গ্রামজুড়ে। সবাই সোৎসাহে যোগ দেয় তাতে। কোনো রকম ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে পালিত হয় লোক উৎসব। এর প্রচলন হয়েছে মূলত ভোজ-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। প্রাচীনকালে শিকারকৃত পশুর মাংস একত্রে বসে খাওয়া এবং নাচ-গানের মাধ্যমে আনন্দ প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে এ অনুষ্ঠান পালিত হতো। পরবর্তীকালে কৃষি ও পশুপালন স্তরে এসে এ উৎসব নতুন মাত্রা লাভ করে এবং বিভিন্ন সময়ে যুগের দাবি অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের লোক উৎসবের সৃষ্টি হয়।

megh-rani

বৃষ্টিআবাহন  
বৃষ্টিআবাহন কৃষিসংক্রান্ত একটি বিশেষ লোক উৎসব। যথাসময়ে বৃষ্টি না হলে কৃষিকাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ফলে সমাজে বিপর্যয় দেখা দেয়। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য নানা ধরনের ক্রিয়াচার পালন করা হয়। সেসবের মধ্যে ব্যাঙবিয়ে, বদনাবিয়ে, মেঘারানী, হুদমাদেও সম্পর্কিত বৃষ্টিআবাহন অনুষ্ঠান এবং পুণ্যিপুকুর ব্রত ও বসুধারা ব্রত উল্লেখযোগ্য। আদিবাসী মেয়েরা বৃষ্টিকামনায় রাতের অন্ধকারে বিবস্ত্র হয়ে দল বেঁধে হুদমাদেও-এর গান গায়।

প্রাচীনকালে আজটেকদের মধ্যে বৃষ্টিদেবতাকে তুষ্ট করার জন্য একটি সুন্দরী কুমারী মেয়েকে নানা অর্ঘ্যসহ উৎসর্গ করার প্রথা ছিল। এতে সমাজের সব মানুষ দলবদ্ধ হয়ে বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে সারা গ্রাম ঘুরত এবং শেষে মেয়েটিকে ছুঁড়ে ফেলে দিত একটি কুয়োর মধ্যে। বৃষ্টিআবাহনের ক্ষেত্রে কাদামাটি অনুষ্ঠানটিও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এতে মেয়েরা কলসিতে জল ভরে বাড়ি বাড়ি ঘোরে এবং মাটিতে জল ঢেলে একজন আরেকজনকে মাখিয়ে দেয়।

মেঘরানী
মেঘরানী উৎসব বিশেষত ফরিদপুর অঞ্চলে পালিত হয়। ‘অাল্লা মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দেরে তুই আল্লা। অাছমান হইলো টুটা টুটা জমিন হইলো ফাটা। মেঘরানী ঘুমাইয়া রইছে মেঘ দিবো কেঠা।’ এমন কিছু গান গেয়ে গেয়ে গ্রামের কিশোর-কিশোরীরা দলবেঁধে গ্রামে ঘুরে ঘুরে চাল-ডাল সংগ্রহ করে। পরে সেগুলো রান্না করে সবাই মিলে খাওয়া হয়। এ দলের মধ্যে একজনকে মেঘারানী সাজতে হয়। উল্লেখ থাকে যে, শর্তানুযায়ী যে কিশোরী মেঘারানী সাজবে তাকে হতে হবে বাবা-মায়ের একমাত্র কন্যাসন্তান। কোনো কোনো অঞ্চলে- ‘ও মেঘ সাজোলো, কালা কইতম দিমু গো, চিনা ক্ষেতে চিনচিনানি, ধান ক্ষেতে আডু পানি, হ্যাদেলো বুন মেঘারানী, মেঘারানীর ভাঙ্গা ঘর, বেইল পরে আড়াই কর, একটা সুপারি একটা পান, এতের কুলা বেতের বান, ঝবঝবাইয়া বিষ্টি নাম।’ বলে গান গাওয়া হয়।

megh-rani

এমনি অনেকে গান গেয়ে কাদা পানিতে নেচে নেচে মেঘারানীকে অাহ্বান করে। হাজার বছরের পুরনো গ্রামীণ ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় গ্রাম বাংলায় পালিত হয় মেঘারাণী উৎসব। চৈত্র শেষে বৈশাখের কিছুদিন চলে গেলেও যখন বৃষ্টির দেখা মেলে না, দাবদাহে অতিষ্ঠ মানুষ তখন এ আয়োজন করে। দাবদাহ থেকে পরিত্রাণ পেতে মেঘরানীকে খুশি করে বৃষ্টি পাওয়া যায় বলে তাদের ধারণা।

কুলানামানো  
কুলানামনো বৃষ্টি প্রার্থনার একটি উৎসবের অংশ। এ উপলক্ষে মহিলারা কুলা সাজিয়ে বাড়ি বাড়ি যায় এবং বৃষ্টির আবাহন জানিয়ে গান গায়।

এসতেস্কা
এসতেস্কা মূলত ধর্মীয় আচার। এলাকার ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা বৃষ্টির জন্য এসতেস্কার নামাজ আদায় করে থাকেন। তারা এলাকার বড় কোনো আলেমকে ইমাম বানিয়ে মুসল্লিদের নিয়ে খোলা মাঠে এ নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষে প্রার্থনা করেন বৃষ্টির জন্য।

এসইউ/এবিএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।