জামদানি বুনতে চাই যাদুর আঙ্গুল


প্রকাশিত: ০২:২৯ পিএম, ২০ ডিসেম্বর ২০১৪

লক্ষ্যা নদীর তীরে ঢেউ টিনের কারখানা ঘরটা রোদে তেতে উঠেছে। ভেতরে এতটাই গরম যে গায়ে যেন লাগছে উনুনের হল্কা। ভেতরে সিলিং থেকে ঝোলানো নগ্ন বাল্বের আলোতে কাজ করছে ছয়জন মানুষ। জোড়ায় জোড়ায় তারা বসে আছে হস্তচালিত তাঁতের সামনে।

পুরুষদের উদোম গা। মহিলাদের পরনে উজ্জ্বল রঙ্গের সালোয়ার-কামিজ। তাদের ব্যস্ত হাত বুনে চলেছে জামদানি শাড়ি। বাংলাদেশের এই জামদানি শাড়ির খ্যাতি বিশ্বজোড়া। মেয়েদের কাছে এর কদর এতটুকু কমেনি। এই শাড়ির দামও অনেক। এই জামদানি শাড়ির কারখানাটি চালান আনোয়ার হোসেন। তাঁতে শাড়ি বুনতে ব্যস্ত কর্মীদের মাঝ দিয়ে তিনি আমাকে নিয়ে যান কাজ দেখাতে।

এক তরুণীর ব্যস্ত হাত মসলিনের ওপর সোনালি সুতে দিয়ে বুনে চলেছে চমৎকার নকশা। “জামদানি শাড়ির দাম বেশি, কারণ এর জন্যে দরকার হয় নিবেদিত প্রাণ কর্মী এবং বিশেষ দক্ষতা”, বললেন আনোয়ার হোসেন। যারা সবচেয়ে দক্ষ তাঁতী, তারা কিন্তু নকশা দেখে শাড়ী বোনে না। নকশাটা তাদের মুখস্ত।

জামদানি শাড়ির খ্যাতি প্রথম শুনি ভারতের কেরালায়। মালাবারের উপকুলে এক অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার হ্যারির কাছে। হ্যারি একসময় কাজ করতেন কোলকাতায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলার নানা মুখরোচক খাবার, আর ঢাকাই জামদানি শাড়ির সঙ্গে তার পরিচয় সেখানেই। এসবের জন্য এখনো স্মৃতিকাতর হ্যারি। “আমার স্ত্রী জামদানি শাড়ির জন্য পাগল। আমিও। এত হালকা এই শাড়ি, যেন হাওয়া দিয়ে বোনা। আমি টাকা জমিয়ে স্ত্রীর জন্য জামদানি শাড়ি কিনতাম।”

জামদানি শাড়ির যে নকশা, সেটা ছাপানো নয়, কিংবা এমব্রয়ডারি করা নয়। শাড়ির কাপড় তাঁতে রেখেই তার মধ্যে অল্প অল্প করে বহুদিন ধরে সেলাই করে ফুটিয়ে তোলা হয় এই নকশা। এ কারণেই এই শাড়ির এত দাম।

নদী থেকে আসা শরীর জুড়ানো বাতাসে আমার চারপাশে উড়ছে ফিরোজা, হলদে আর সাদা কাপড়। তার মধ্যে নীরবে কাজ করে চলেছে তাঁতীরা। এখানে কোন কারখানার শব্দ নেই। কোন মেশিন নেই। কেবল নিঃশব্দে কাজ করে যাওয়া। ঢাকার শত শত পোশাক কারখানা, যেখানে তৈরি হচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য সস্তার কাপড়, সেখান থেকে রূপসা আর ডেমরার এই জামদানি পল্লীর পরিবেশ যেন একেবারে ভিন্ন এক জগত।

একেকটি জামদানি শাড়ি তৈরিতে সময় লাগে তিন থেকে চার মাস। যে মহিলারা এখানে কাজ করেন, তারা নিজের কাজ নিয়ে গর্বিত। কিন্তু দক্ষ জামদানি তাঁতীর সংখ্যা কমছে। আনোয়ার হোসেন জানেন, তার কর্মীরা তার কাছে কতটা মূল্যবান।

জামদানি শাড়ির রহস্যটা আসলে কি? একজন দক্ষ তাঁতীর গুনগুলো কি? আনোয়ার হোসেনের উত্তর, “এটা রক্তের মধ্যে থাকতে হয়, তাদের তাঁতীর ঘরেই জন্ম নিতে হবে। থাকতে হবে শক্ত মেরুদন্ড। সেই সঙ্গে নিষ্ঠা।”

“আর সবচেয়ে জরুরী যেটা, তা হলো, তাদের থাকা চাই যাদুর আঙ্গুল, যে আঙ্গুলে তারা বুনবেন জামদানি শাড়ি। আর এই যাদুর আঙ্গুলই এখন সবচেয়ে দুর্লভ।” খবর: বিবিসি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।