পরিত্যক্ত সুইমিং পুলে রঙের ছটা

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:২১ পিএম, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

ইমন ইসলাম

কিছুদিন আগেও যে ময়লার ভাগাড় ছিল দৃষ্টিকটু ও বিরক্তির কারণ, আজ তা সেজেছে রঙিন সাজে। ময়লার ভাগাড় বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। বলছিলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সুইমিং পুলের কথা। শিক্ষার্থীদের সাঁতারের জন্য এই সুইমিং পুল তৈরি হলেও অচিরেই তা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।

বর্তমানে পুরো সুইমিং পুল যেন সেজেছে বসন্তের নতুন রঙে। নানান চিত্র ফুটে উঠেছে পরিত্যক্ত সুইমিংপুলের দেয়ালে। দৃষ্টিনন্দন এসব চিত্রকর্ম নজর কাড়ছে সবার। এ শুধু রঙের খেলা নয়। এতে মিশে আছে চিত্রশিল্পীদের ঘাম আর ক্লান্তি। চিত্রকর্মগুলো সেই ক্লান্তি মুছে দিয়ে তাদের মনে এনে দিয়েছে ফুরফুরে ভাব। যা দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন সবাই।

jagonews24

একসময় ঘোরাঘুরির জন্য এই এলাকা এড়িয়ে চললেও শিক্ষার্থীদের জন্য এখন সেই এলাকা হয়ে উঠেছে প্রশান্তির। একটি সুন্দর উদ্যোগ কীভাবে একটি এলাকাকে বদলে ফেলতে পারে, ক্যাম্পাসের পরিত্যক্ত সুইমিং পুল তার জলজ্যান্ত উদাহরণ।

আরও পড়ুন

ফুটপাতে চা বিক্রি করতেন, এখন কফি শপের মালিক 

শারীরিক শিক্ষা বিভাগের অদূরে জঙ্গলের মাঝে পরিত্যক্ত জায়গা ছিল। স্যাঁতসেঁতে ওই জায়গা থেকে জন্মাত মশা-মাছি। মাঝেমধ্যে দুর্গন্ধও ছড়াত। যে জায়গায় ময়লা-আবর্জনার স্তূপ ছিল, সেখান থেকে এখন রঙিন ছবির আলোকছটা ছড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দলে দলে এমন মোহনীয় সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসছেন। কেউবা আবার ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে সেই অনুভূতি গুলোই প্রকাশ করছেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই একমাত্র পুলটি পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাবে বন্ধ হয়ে যায় একসময়। সময়টা ছিল ১৯৯৬ সাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র সুইমিং পুলে পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। এতে সুইমিং পুলের তলানিতে জমতে থাকে নোংরা পানি। এছাড়া দীর্ঘদিন ব্যবহার না হওয়ার ফলে আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয় লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ অবকাঠামোটি। এদিকে সুইমিং পুলের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ভৌগোলিক কারণেই তা রূপ নেয় পরিত্যক্ত স্থানে।

jagonews24

পরিত্যক্ত ‘সুইমিং পুল’। ময়লা–আবর্জনা ও মাদকের আখড়া হিসেবে জনপ্রিয় ছিল যে পুল। নিরিবিলি ও ঘন জঙ্গলের মধ্যে হওয়ার দরুন নানা অনৈতিক কাজের আখড়া হিসেবেই চিনতো সবাই। এতদিন আবর্জনার স্তূপ হিসেবে পরিচিত থাকলেও রাতারাতি এই পুলের পরিবর্তন এনে দিয়েছেন কয়েকজন চিত্রশিল্পী। যার সুবিধা ভোগ করছে এখন পুরো ক্যাম্পাসবাসী। পুরোনো জরাজীর্ণ এই পুলটি দৃষ্টিনন্দন করতে উদ্যোগ নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের ৪২ ব্যাচের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ মামুর। তার উদ্যোগে এক দল তরুণ নেমে পড়েন রঙিনায়নে।

মাত্র এক মাসের ব্যবধানে জীর্ণ দেয়ালে ফুটেছে রঙিন ছবি। পুলের দুই পাশের দেয়ালে জায়গা পেয়েছে বাহারী সব চিত্রকর্ম। রং-তুলি কেনা থেকে শুরু করে দেয়ালে রং সবই তারা করেছে। যার দরুণ সুইমিং পুল এলাকার শোভা আরও বর্ধিত হয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে সুষ্ঠু পরিবেশে বেড়ে উঠতে পারে, তাই তাদের এই পদক্ষেপ নেওয়া। দীর্ঘদিনের অপরিচ্ছন্ন নোংরা পুলটি এখন আবর্জনামুক্ত। এখন এ পুলের পরিবেশ নিয়ে শিক্ষার্থীরাও রয়েছেন বেশ স্বস্তিতে। পুলের পাশে বিনেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

মরুভূমির উটের খামার রাজধানীতে 

এ বিষয়ে আবদুল্লাহ মামুর বলেন, ‘এর আগে ক্যাম্পাসের দেয়ালে অনেক দেয়ালচিত্র এঁকেছি আমরা, কিন্তু সেটা ছোট পরিসরে, গুটিকয়েকজন মিলে। ওই কাজ গুলো করতে গিয়েই আসলে মাথায় আসে যে জাহাঙ্গীরনগরের চারুকলা বা অন্যান্য বিভাগের যেসব শিক্ষার্থী ছবি আঁকে, তাদের নিয়ে একটি দেয়ালচিত্র উৎসব করার। সেই ভাবনা থেকেই এটার পরিকল্পনা করি।

jagonews24

আঁকার জন্য পরিত্যক্ত সুইমিংপুল বেছে নেওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, জায়গাটা বহুবছর ধরে পরিত্যক্ত, মানুষজন প্লাস্টিকসহ নানা ধরনের ময়লা আবর্জনা ফেলে জায়গাটা ময়লার ভাগাড়ে পরিণত করে রেখেছিল। সেসব আবর্জনা পরিষ্কার করে এখানে আঁকার একটা উদ্দেশ্য হলো মানুষজনকে একটা বার্তা দেওয়া যে, আমরা প্লাস্টিক এবং অন্যান্য যাবতীয় ময়লা-আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলে পরিবেশ নষ্ট না করি। আমাদের আশপাশ আমরা অপরিষ্কার না করলে কখনোই অপরিষ্কার হবেনা।’

যেসব ছবি আঁকা হয়েছে সেসবের ভেতর কিছু ছবি সরাসরি বার্তা বহন করছে। যেমন রনবীর বিখ্যাত টোকাই চরিত্রকে নিয়ে আঁকা একটি দেয়ালচিত্রে ফুটে উঠছে যে টোকাই একটি কাটা গাছে হেলান দিয়ে আরাম করে শুয়ে আছে, তার চোখে ভিআর সেট, সেখানে লেখা ‘উন্নয়ন’। বর্তমানে যেভাবে পরিবেশ নষ্ট করে, গাছ কেটে উন্নয়ন করা হচ্ছে এবং এটা নিয়ে কারও তেমন কোনো বিকার নেই, সেটার দিকেই আসলে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।

এর বাইরে গ্রাম বাংলার জীবন, কিংবা আধুনিক নগরে নাগরিল জীবন নিয়েও আঁকা হয়েছে ছবি। এছাড়াও অসংখ্য আঁকিয়ে তাদের নিজেদের খেয়ালখুশিতে রং ছড়িয়ে নানাভাবে রঙিন করেছে পরিত্যক্ত এই সুইমিংপুলটিকে।

দেয়ালচিত্রগুলো দেখে সবাই খুবই উচ্ছ্বসিত। সবাই খুবই প্রশংসা করছে এবং প্রচুর ছবি তুলছে। এটা আসলেই খুবই আনন্দের। তবে দর্শনার্থী যারা ছবি তুলছেন বা দেখতে আসছেন তাদের প্রতি একটা অনুরোধ যে তারা যেন দেয়ালে পা তুলে না দাঁড়ায় কিংবা দেয়ালে পা তুলে ছবি না তোলে। এতে ছবি গুলো জুতার ময়লাতে নষ্ট হয়ে যাবে। আর তারা যেন অবশ্যই ময়লা-আবর্জনা সুইমিংপুলে রাখা ডাস্টবিনে ফেলে। যত্রতত্র আবর্জনা ফেলে পরিবেশ নষ্ট না করে।

মানুষের কল্পনাশক্তিকে জাগিয়ে তোলে নানা রং। আর কল্পনাকে ফুটিয়ে তুলতে মানুষ হাতে নেয় রং আর তুলি। এই দুইয়ে মিলিত রূপ কল্পনাকে জাগিয়ে তোলে ক্যানভাসে। আমাদের চোখের সামনে ফুটে ওঠে অপরূপ দৃশ্যাবলী। তাতে বুঁদ হয়ে যায় গোটা জগৎ। ছবি আঁকার শখ কম-বেশি সকলেরই থাকে। তুলি হাতে ক্যানভাসে নানা রঙের আঁচড় টানা মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা রঙের জাদুকরকে বাইরে বের করে আনার মতো আনন্দ জাগে। মনের আবেগ, উচ্ছলতা সবই যেন ফুটে ওঠে তুলির বাহারি রঙে।

jagonews24

বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ৪৭-ব্যাচের শিক্ষার্থী খুরশিদা জাহান খুশি ঘুরতে যান পুরোনো সুইমিং পুল প্রাঙ্গণে। পুরোনো সুইমিং পুলের নয়া সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ছবি পোস্ট করেন ফেসবুকে। তিনি জানান, আগমনী ফাল্গুনকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ক্যাম্পাসের সুইমিং পুলের প্রতিটি দেওয়াল এক অনন্য রঙের  সাজে সজ্জিত হয়েছে। এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে সুইমিং পুলের ওয়াল পেইন্টিং দেখে আমি সহ ক্যাম্পাস এর অনেকেই অনেক বেশি বিমোহিত। দেওয়ালে আকা নানা রঙের চিত্র তার সঙ্গে বিকেলে সূর্যের আলো যখন সুইমিংপুলের পানিতে প্রতিফলিত হচ্ছে সেটা দেখতে আরও বেশি সুন্দর লাগছে।

লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ,জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

আরও পড়ুন

কেএসকে/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।