প্রতিবন্ধী দিবস

বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি

ডা: সেলিনা সুলতানা
ডা: সেলিনা সুলতানা ডা: সেলিনা সুলতানা
প্রকাশিত: ১২:০৯ পিএম, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩

প্রতি বছর ৩ ডিসেম্বর বিশ্বে পালিত হয়ে আসছে জাতিসংঘের বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক দিবস (আইপিডি)। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৪৭/৩ রেজুলেশনে ঘোষণার পর থেকেই দিবসটি পালিত হয়। দিবসটি পালনের লক্ষ্য হলো সমাজের সর্বস্তরে বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের সমান অংশগ্রহণ ও উন্নয়নে তাদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের মর্যাদা, অধিকার এবং সুস্থতার জন্য সমর্থন জোগাড় করা। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য সমস্ত মানবাধিকার পূরণে জাতিসংঘের ব্যাপকভাবে অনুসমর্থিত কনভেনশন এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য ২০২৩ এজেন্ডা দিবসটিকে শক্তিশালী করেছে। ‘৩২তম আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস’ ও ‘২৫তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস ২০২৩’ এর প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সাথে সম্মিলিত অংশগ্রহণ, নিশ্চিত করবে এসডিজি অর্জন’।

করোনা পরবর্তী বিশ্বের একাধিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে এসডিজি অর্জন কিছুটা হুমকির মুখে। বিশ্ব ২০৩০ সালের মধ্যে অসংখ্য এসডিজির লক্ষ্যে পৌঁছানোর ট্র্যাকে নেই। অনেকের জন্য, অগ্রগতি হয়ে থেমে গেছে বা ২০১৫ বেসলাইনের নিচে চলে গেছে। দুর্ভাগ্যবশত, বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র এবং সবচেয়ে দুর্বলরা প্রায়ই সংকটের সময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আসন্ন ইউএন ডিসেবিলিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০২৩ থেকে প্রাথমিক ফলাফলগুলো থেকে দেখা যায় যে, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য বেশ কয়েকটি এসডিজি পূরণে বিশ্ব আরও বেশি ট্র্যাক থেকে দূরে আছে। তাদের জন্য, তাদের সাথে এবং তাদের দ্বারা এসডিজি অর্জনের জন্য আমাদের প্রচেষ্টাগুলোকে আরও জোরদার এবং ত্বরান্বিত করা দরকার। কারণ তারা প্রায়ই পেছনে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে রয়ে যায়।

প্রতিশ্রুতি, অর্থায়ন এবং কর্মের মৌলিক পরিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ, আর এর অবিচ্ছেদ্য বিষয় হলো তাদের চাহিদা এবং অগ্রাধিকারের অন্তর্ভুক্তি। সাম্প্রতিক এসডিজি শীর্ষ সম্মেলনের রাজনৈতিক ঘোষণাপত্র গৃহীত হওয়ার সাথে সাথে, বিশ্ব নেতারা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিসহ দরিদ্রতম এবং সবচেয়ে দুর্বলদের লক্ষ্য করে এমন নীতি ও কর্মের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, টেকসই উন্নয়ন এবং সবার জন্য ভাগ করে নেওয়া সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য নিজেদের পুনরায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করেছেন। এটি তাদের জন্য এবং তাদের দ্বারা এসডিজিগুলোকে বাস্তবে পরিণত করার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে সদস্য রাষ্ট্রগুলো, জাতিসংঘের ব্যবস্থা, সুশীল সমাজকে পুনরায় সক্রিয় করার আহ্বান জানায়।

আরও পড়ুন: মণিপুরীদের রাস উৎসব যেভাবে এলো 

দেশে অনেকদিন ধরেই ‘প্রতিবন্ধী দিবস’ পালন করা হলেও এর তাৎপর্য আমরা ঠিকভাবে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছি। প্রায় এক যুগ হতে চলল বাংলাদেশ বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তির অধিকার সনদে অনুস্বাক্ষর করেছে। কিন্তু এতে তাদের ভাগ্যের ও যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে; তাদের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। সুযোগ বাড়লেও চাকরির বাজারে দেখা যায়, অনেকেই যোগ্যতা অনুযায়ী টিকে থাকতে পারছে না। সরকার শিক্ষা ক্ষেত্রে উপবৃত্তি দিচ্ছে, ভাতার পরিমাণও বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু সেবা গ্রহণের পথ এখনো সুগম হয়নি। এ ছাড়া বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তি শনাক্তকরণ প্রক্রিয়ায় রয়েছে অনেক হয়রানি ও দীর্ঘসূত্রতা, সেই দীর্ঘসূত্রতার প্রভাব পড়ে ভাতা পাওয়ার ওপর।

আমাদের দেশে এখনো তাদের প্রবেশগম্যতার অভাব সর্বত্র। কারণ রাস্তা, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ঠিকমতো মানা হচ্ছে না। তার জন্য কোনো শাস্তির ব্যবস্থাও দেখা যাচ্ছে না। এ ছাড়া গণপরিবহন ব্যবস্থা এখনও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন বান্ধব নয়। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও বৈষম্য বিরাজমান। তাদের জন্য আলাদা কোটা ব্যবস্থার বাস্তবায়ন নেই সবখানে। তাদের অধিকার ও সুরক্ষা আইনের কমিটিগুলোও কার্যকর নয়। যার কারণে তাদের অধিকার অর্জনে কোনো অগ্রগতি নেই। ফলে তারা কর্মসংস্থান, শিক্ষা, সামাজিক ও অন্য ক্ষেত্রে সমান সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

দেশের বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। যদিও এটা ঠিক যে, তারা যদি প্রয়োজনীয় সমর্থন পায় তবে তাদের সক্ষমতা প্রমাণ করতে পারে এবং জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। তারা নানা ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তাদের সম্পর্কে ভুল ধারণার কারণে। বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের মতামত সাধারণত গ্রাহ্য করা হয় না এবং প্রায় ক্ষেত্রেই তাদের অধিকার লঙ্ঘন করা হয়, যেটা শেষ পর্যন্ত তাদের উন্নয়নের মূল স্রোতধারা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। তাদের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় গঠন করা হলে তবেই তাদের অধিকার আদায় ও স্বার্থ রক্ষায় সহায়ক হবে বলে মনে হয়।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬১তম অধিবেশনে ১৩ ডিসেম্বর ২০০৬ সালে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষাবিষয়ক সনদ অনুমোদন করা হয়। বাংলাদেশ সরকার সনদটি ৩০ নভেম্বর ২০০৭ সালে অনুস্বাক্ষর করে। আমাদের দেশে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন বিষয়ে দুটি আইন আছে। ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩’ এবং ‘নিউরো-ডেভেলপমেন্ট প্রতিবন্ধী আইন-২০১৩’। এই আইন দুটির বাস্তবায়ন জরুরি। আইনগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায় আমাদের দেশের বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।

আরও পড়ুন: ৭ নভেম্বরের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন যে নোবেলজয়ীরা 

ওই আইনের ১৬ ধারায় বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের বিভিন্ন অধিকার সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। সেগুলো হলো- যে কোনো বিষয়ে পরিপূর্ণ প্রবেশাধিকার, প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে পরিপূর্ণ ও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ, অত্যাচার ও নির্যাতন থেকে সুরক্ষা, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ, সংকেত ভাষার শ্রবণ এবং বাক-প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য প্রধান ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান, নিজের সাহায্য নিজেই করি- এমন গ্রুপ (সেলফ হেল্প গ্রুপ) বা কল্যাণভিত্তিক সংগঠন তৈরি ও পরিচালনা করা।

জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশকে উন্নয়নের বাইরে রেখে কোনো দেশের পক্ষে এগিয়ে যাওয়া কখনোই সম্ভব নয়, তাদের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। তাই আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস উপলক্ষে এটি আমাদের প্রত্যাশা, আমাদের দেশে বিশেষ চাহিদা সম্পন্নরা সমাজের মূল ধারায় সম্পৃক্ত হবে এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সবার অধিকার সুনিশ্চিত করার মাধ্যমে বৈষম্যহীন সমাজ গঠিত হবে, জাতীয় উন্নয়ন দ্রুত হবে।

লেখক: কনসালটেন্ট, নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার এবং চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্ট, বেটার লাইফ হসপিটাল। প্রাক্তন অটিজম বিশেষজ্ঞ, ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল।

এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।