বিউটি বোর্ডিং
ঘর আছে, আড্ডা নেই
সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেছে পুরোনো সেই জৌলুস। অতীতের ঐতিহ্য ও রোমাঞ্চকর স্মৃতি নিয়ে নোনাধরা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে বিউটি বোর্ডিং। গায়ের হলুদ রঙ ঝলসে গেছে অনেক আগেই। সেই ভবন আর কক্ষগুলো দাঁড়িয়ে আছে আগের মতোই। আড্ডায় প্রাণের সঞ্চার হয় না কতকাল। পুরান ঢাকায় অবস্থিত এ বিউটি বোর্ডিং একসময় ছিল দেশবরেণ্য কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডার কেন্দ্রস্থল। এখানেই জমে উঠতো সরস আড্ডা। ঘরগুলো আগের মতো থাকলেও নেই সেই মানুষ, সেই সংস্কৃতি, সেই আড্ডা।
বাংলাবাজারের বইয়ের দোকানগুলোকে পেছনে ফেলে প্যারিদাস রোডের দিকে একটু সামনে এগোলে দেখা মিলবে জীর্ণ একটি দেওয়ালে লেখা বিউটি বোর্ডিং। গেট পেরোলেই একটু ফাঁকা জায়গা। তার বাম পাশে মৌসুমী ও পাতাবাহার ফুলের গাছ। বাগানের মাঝে আড্ডাস্থল। কাপড়ের বড় ছাতার নিচে বসার জন্য টেবিল ও চেয়ার। এর পাশেই অতিথিদের খাবারের জায়গা। বাড়ির দেওয়ালের অনেক জায়গায় লেখা ‘বিউটি বোর্ডিং’। এছাড়া দেওয়ালের গায়ে রয়েছে এ বোর্ডিংয়ের সংস্পর্শে আসা স্মৃতিবিজড়িত মহৎ মানুষগুলোর নাম। তার পাশে টানানো বোর্ডিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহার ছবি।
আরও পড়ুন: ইতিহাসের সাক্ষী বিউটি বোর্ডিং
তার পাশেই বিউটি বোর্ডিংয়ের ডাইনিং। এটিও বেশ জনপ্রিয়। ভোজন রসিকরা আসেন নিয়মিত। এখানকার লুচি পরোটা, সরষে ইলিশের ভক্ত পুরান ঢাকাবাসী। এখানে কর্মচারীর সংখ্যা আটজন। সিঙ্গেল ও ডাবল মিলিয়ে এই বোর্ডিংয়ে থাকার জন্য কক্ষ আছে ২৫টি। দর্শনার্থীরা চাইলেই থাকতে পারেন। এক্ষেত্রে কক্ষভেদে রয়েছে নির্দিষ্ট ভাড়া। ফ্যামিলি ডাবল বেড ১ হাজার ৪০০ টাকা, ব্যাচেলার ডাবল বেড ৮০০-৯০০ টাকা। সিঙ্গেল বেড নিচতলা ৩০০ টাকা ও উপর তলা ৪০০ টাকা।
একটা সময় ছিল সত্তর আশির দশকের দিকে বিউটি বোর্ডিংয়ের আড্ডা আমাদের দেশের শিল্প সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছে। এখানেই রচিত হয়েছে অজস্র কালজয়ী কবিতা, উপন্যাস, গল্প, চলচ্চিত্র কিংবা অন্যান্য শিল্পকর্ম। কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা, সাংবাদিক, রাজনীতিক, টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব আর জাদুশিল্পীদের পদচারণায় মুখরিত থাকতো সবসময় এই বিউটি বোর্ডিং।
বর্তমানে বিউটি বোর্ডিংয়ে কবি সংসদ নামে একদল লোক মাঝে মাঝে কবিতার আসর জমায়। সেইসাথে বর্তমান প্রজন্মের কবি সাহিত্যিকরাও ঐতিহ্যের টানে এখানে আসে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও স্থানীয়রা সময় পেলেই মাঝেমধ্যে এখানে ঘুরতে আসে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আড্ডাটা এখন আর তেমন জমে ওঠে না। সাহিত্যের আসর বসে না। মাঝে মাঝে আশপাশ হতে সাধারণ মানুষ ঘুরতে আসে। কখনো কখনো জোট বেঁধে দেশের এ পুরোনো আড্ডাখানা দেখতে আসেন অনেকেই। তরুণ-তরুণীরা ছবি তোলা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। সিঙ্গেল মানুষজন ঢাকা শহরে কোনো কাজে আসলে রাতযাপন করেন। এতটুকুই চলে বিউটি বোর্ডিংয়ে।
আরও পড়ুন: আড্ডার প্রাণ বিউটি বোর্ডিং
বর্তমানে বিউটি বোর্ডিংয়ের দায়িত্বে আছে প্রতিষ্ঠাতা প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহার বংশধর। বোর্ডিং পরিচালনা করেন তার ছেলের সমর সাহা। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবা শহীদ হন। আমার ভাইও আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে গেছেন। দিন দিন আড্ডা কমে যাচ্ছে। যান্ত্রিক কোলাহলে মাঝে মাঝে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসে। বিদেশিরা আসেন। কিন্তু আগের মতো আড্ডা আর জমে না। চেষ্টা করছি বোর্ডিংয়ের ঐতিহ্য ধরে রাখতে। কিন্তু কতদিন পারবো তা জানি না।
বিউটি বোর্ডিংয়ে ঘুরতে এসেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী রাজিব। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, বিউটি বোর্ডিং সম্পর্কে গুগলে অনেক পড়েছি। সেই জানা থেকে এখানে আসা। খুব কোলাহল মুক্ত একটি জায়গা। ভেতরে এসে গাছগুলোর পাশে আড্ডা দিয়ে ভালোই লাগছে। তবে নিয়ম করে বন্ধুরা এসে যদি সাহিত্যিক আড্ডা দিতে পারতাম ভালো লাগতো। পুরান ঢাকার যানজটের কারণে আসতে ইচ্ছা করে না।
জানা যায়, বিউটি বোর্ডিংয়ে প্রথমে ছিল সোনার বাংলা পত্রিকার অফিস। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে। লোকে জমিদারবাড়ি বলেই চিনত। কেননা, এ বাড়িটি ছিল জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসের। তিনি ভারত চলে গেলে বাড়িটিতে গড়ে ওঠে একটি ছাপাখানা। আর এখান থেকেই প্রকাশিত হতো সোনার বাংলা পত্রিকাটি। দেশভাগের পর পত্রিকা অফিসটি স্থানান্তরিত হয়ে কলকাতায় চলে গেলে ১৯৪৯ সালে নলিনী মোহন সাহা ও প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা ১১ কাঠা জমি কিনে নেন তৎকালীন জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসের কাছ থেকে। এ জমিতেই গড়ে তোলেন ঐতিহাসিক এ বিউটি বোর্ডিং। নলিনী মোহনের বড় মেয়ে ছিলেন বিউটি আর তার নামেই এর নামকরণ হয়।
আরও পড়ুন: পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বিউটি বোর্ডিং
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে প্রহ্লাদ সাহার দুই ছেলে সমর সাহা ও তারক সাহা পুনরায় এ বিউটি বোর্ডিংয়ের প্রাণ ফেরাতে এটি আবার চালু করেন। বিউটি বোর্ডিংয়ের প্রাণ ফেরানো তাদের কাছে মোটেও সহজ ছিল না। এই যখন অবস্থা তখন ইমরুল চৌধুরী ১৯৯৫ সালে গড়ে তোলেন বিউটি বোর্ডিং ‘সুধী সংঘ’। তার হাত ধরে ১৯৯৮ সালে ৬০ সদস্য বিশিষ্ট ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়। ২০০০ সাল থেকে এ বোর্ডের মাধ্যমে কবি-সাহিত্যিকদের সম্মাননা দেওয়া শুরু হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় সম্মাননাপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন বেলাল চৌধুরী, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, দেবদাস চক্রবর্তী, সৈয়দ শামসুল হক, সমরজিৎ রায় চৌধুরীসহ উল্লেখযোগ্য কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক।
আরএ/এসএইচএস/জিকেএস