দুই দেশের যুদ্ধ থেমে যায় তার জন্য

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩:৫০ পিএম, ০৮ জানুয়ারি ২০২৩

 

বখতিয়ার আবিদ চৌধুরী

বিংশ শতকের প্রায় শেষদিকে আমেরিকায় কালো মানুষের কন্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন মার্টিন লুথার কিং এবং সাউথ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলা। একদিকে তাদের আগুনঝরা কন্ঠস্বর বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কেড়ে নিচ্ছিল, অন্যদিকে চির উপেক্ষিত সেইসব মানুষের অধিকার আদায়ে রাজনীতির মাঠ চষে বেড়াচ্ছিলেন তারা!

একটু ব্যতিক্রমভাবে তাদের সমসাময়িক সময়ে অ্যামাজন ঘেরা লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলের সবুজ ফুটবল মাঠজুড়ে দূরন্ত গতিতে ছুটে বেড়াচ্ছেন আরেকজন কালো মানুষের মুখ, ইউরোপীয় শ্বেত ফুটবল সম্রাজ্যের মুখে থাবা বসিয়ে দিয়েছেন ততদিনে, একটু পেছনে ফিরে তাকালে এ মানুষটিকে দেখা যাবে ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপে, তখন তার বয়স মাত্র ১০। মারাকানা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ফাইনালে ব্রাজিল হেরে যাওয়ার পর বাবাকে শান্তনা দিতে বলেছিলেন,‘বাবা, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, আমি তোমাকে প্রতিশ্রুতি দিলাম, একদিন আমি তোমার জন্য ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপ জিতব।’

jagonews24

ছোট্ট ছেলেটি বাবাকে দেওয়া কথা রেখেছিলেন, একবার নয় তিন-তিনবার, ব্রাজিলের অধরা সে শিরোপাটি জয় করন তিনি। সেই ছেলেটির নাম এডসন অ্যারানটিস দো নাসিমেন্ট। যিনি পেলে নামে সমাদৃত বিশ্বের ফুটবল প্রেমীদের কাছে। পেলে নামটি কিন্তু তার বাবা-মা রাখেননি। কয়েক বছর আগে ভারতের দিল্লিতে একটি অনুষ্ঠানে এসে এমন প্রশ্নের মুখে মূল ঘটনাটি বর্ণনা করেন পেলে নিজেই।

পেলে বলেন, ‘বিখ্যাত আবিষ্কারক টমাস আলভা এডিসনের সঙ্গে মিলিয়ে বাবা আমার নাম রেখেছিলেন। যখন ফুটবল খেলা শুরু করলাম তখন আমাকে সবাই ‘পেস’ বলে ডাকতো। ‘পেস’ মানে হচ্ছে পা। পর্তুগিজ ভাষায়
ফুটবলে শট মারাকে বলা হয় ‘পেস’। এই ‘পেস’ থেকেই এক সময় আমাকে ‘পেলে’ নামে ডাকা শুরু হলো।’

১৯৬১ সালের কথা, অতিমানবিয় ফুটবল দক্ষতার জন্য সারাবিশ্বে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছিলেন পেলে, ইউরোপীয় বিভিন্ন লীগের নামি সব ক্লাব থেকে লাগাতার ডাক আসছিল, কিন্তু ফুটবলের দেশ ব্রাজিলের মানুষের পেলের প্রতি যে আবেগ জন্মেছিল তার কাছে হার মানতে হয় সে সময়কার ব্রাজিল সরকারকে। পেলেকে জাতীয় সম্পদ ঘোষণা করে ব্রাজিলিয়ান সরকার। ব্রাজিলের বাইরে বিদেশি কোনো ক্লাবে পেশাদারি ভাবে পেলের আর খেলা হয়নি এরপর। তবুও তার বিশ্বজয় কেউ ঠেকাতে পারেনি। ব্রাজিলে থেকেই বিশ্ব ফুটবলের ভীত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি, জয় করেছেন ফুটবল রাজ্য, আর সে রাজ্যবাসীরা তাকে ফুটবল সম্রাট হিসেবে বরণ করে নিয়েছেন, মাথায় পরিয়ে দিয়েছেন মুকুট।

ফুটবলে অকুণ্ঠ অর্জন ছাড়াও ফুটবল বিশ্ব পেলেকে মনে রাখবে ভিন্ন একটি কারণে, পেলের জন্য যে নাইজেরিয়ার যুদ্ধ থেমে গিয়েছিল! হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। নাইজেরিয়ার পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো ‘বায়াফ্রা’ নামক পৃথক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে এক জোট হয়ে যুদ্ধ করছিল। এই যুদ্ধে মারা যায় ২০ লাখেরও বেশি বেসামরিক মানুষ। ঘরছাড়া হয় আরও ৪৫ লাখ মানুষ।

jagonews24

এই যুদ্ধের মাঝেই নাইজেরিয়ার মাঠে নামে সান্তোস ফুটবল দল। লাগোসে ২৬ জানুয়ারি একটি ম্যাচ খেলেন পেলেরা। ২০০৫ সালে টাইম ম্যাগাজিন তাকে নিয়ে লিখেছিল, ‘বড় বড় কূটনীতিবিদরা দুই বছর চেষ্টা করেও আফ্রিকার ভয়ংকরতম এই রক্তপাত থামাতে পারেননি। কিন্তু ১৯৬৯ সালে নাইজেরিয়ায় ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলে পা রাখার পর তিন দিনের জন্য যুদ্ধ থেমেগিয়েছিল।’

সে প্রীতি ম্যাচে নাইজেরিয়ার সঙ্গে ২-২ গোলে ড্র করে সান্তোস। জোড়া গোল করেছিলেন পেলে। দর্শকদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন উঠে দাঁড়িয়ে সম্মাননা। সেই অদম্য পেলে ৮২ বছর বয়সে থেমে গেলেন পৃথিবীর রূঢ় সত্যের কাছে। ২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর চলে গেলেন ফুটবল সম্রাট। কিন্তু তিনি রয়ে যাবেন ফুটবলের সম্রাট হয়ে ফুটবলপ্রেমীদের মনে।

লেখক: শিক্ষার্থী, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজ।

কেএসকে/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।