‘কালো মানুষ’ কীভাবে গেলো আমেরিকা?
বলা হয়ে থাকে, মহান আমেরিকা, গ্রেট আমেরিকা! আমেরিকা শব্দটা ভাবলেই সাদা চামড়ার সাহেবদের কথা মনে পড়ে যায়। অথচ ওই আমেরিকাতেই যে বিপুল সংখ্যক কালো চামড়ার মানুষ রয়েছে সে কথা আমাদের অনেক সময় খেয়ালই থাকে না। আমেরিকার আদি অধিবাসী যে ইন্ডিয়ান এটা প্রায় সবারই জানা কথা। তবুও প্রশ্ন উঠে- কালো মানুষ আমেরিকার অধিবাসী কীভাবে হলো?
সত্যি ভেবে দেখার মতো প্রশ্ন বটে! এক দেশের লোক আরেক দেশে গিয়ে বসতি স্থাপন করার ঘটনা যদিও পৃথিবীতে বিরল কোনো ঘটনা নয়। কালক্রমে সেখানকার স্থায়ী অধিবাসীতেও পরিণত হয়। যারা আগে থেকেই সেখানে ছিল তারা তখন হয়ে যায় আদীবাসী। আমেরিকান ইন্ডিয়ানরাও ঠিক তেমনই। এসব তথ্য সবার জানা থাকলেও একটা তথ্য হয়তো সাধারণ অনেকেরই অজানা। তা হলো কালো মানুষরা আমেরিকাতে প্রথম যায়- এক্সপ্লোরার বা অনুসন্ধানী হিসেবে। সাধারণত যেটা ভাবা হয় ‘দাস বা গোলাম’ হিসেবে নয়। তবে প্রথমে সে রকম কিছু ঘটেনি।
ইতিহাস বলে, আবিষ্কারের নেশায় যেসব স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ এবং পর্তুগীজরা সাগরে জাহাজ ভাসায় তাদের সে সময়ের সঙ্গী ছিল নিগ্রোরা। প্রশান্ত মহাসাগর আবিষ্কারে সাদা চামড়ার মানুষের সঙ্গী ছিল কালো মানুষ। মেক্সিকো অনুসন্ধানের সময়ও সঙ্গী হয়েছিল কালো মানুষ। এই কালো মানুষরাই ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ এবং পর্তুগীজদের সঙ্গে থেকে খুঁজে বেড়িয়েছে উত্তর আমেরিকার মধ্যভাগ। গিয়েছিল নিউ মেক্সিকো, আরিজোনা এবং মিসিসিপি ভ্যালিতে। নতুন পৃথিবীকে গম চাষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল কারা? উত্তর কালো মানুষরাই। পরে কালো মানুষরা নতুন পৃথিবীতেও (নিউ ওয়ার্ল্ড) এ যায়। তবে তা একেবারে অন্যভাবে। বলা হয়ে থাকে, তাদেরই আবিষ্কৃত দেশে তাদেরকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ‘গোলাম’ হিসেবে। ১৬১৯ সালে একটি ডাচ নৌযানে করে ভার্জিনিয়ার জেমস্টাউনে নেওয়া হয় ২০ জন নিগ্রোকে। জাহাজের ক্যাপ্টেন কিছু শর্তের বিনিময়ে বিক্রি করে দেয় তাদের। ওই সময়টাতে প্রচুর সাদা মানুষও আমেরিকা যায় চুক্তিবদ্ধ চাকর হিসেবে কাজ করার জন্য। এই চুক্তিবদ্ধের অর্থ হলো, একটি নির্দিষ্ট সময়কালের কর্মকে কিনে নেওয়া বা বিক্রি করা। কিন্তু যখনই চুক্তিবদ্ধ শ্বেতাঙ্গ শ্রমিকদের ইউরোপ থেকে আসা বন্ধ করে দেওয়া হলো তখনই গাদা গাদা কালো ক্রীতদাস ধরে আনা হলো কলোনীগুলোতে। এটা শুরু হয় ১৬৮৮ সালে। ১৭১৫ সালে গিয়ে কালো ক্রীতদাসের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৮ হাজার। ১৮০০ সালে গিয়ে এই সংখ্যা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৫ লাখেরও বেশি।
নৃতাত্ত্বিক গবেষকরা জানান, সাদা মানুষের তুলনায় কালো মানুষ দুর্দান্ত সাহসী, শিকারি হয়। মূলত ফ্লোরিডা, লুইজিয়ানার মতো দক্ষিণের জলাভূমি অঞ্চলে এদের সাহসিকতা দেখার মতো ব্যাপার বৈকি! এরা এতটাই সাহসের অধিকারী যে, ভয় ডর কাকে বলে ওরা জানে না। সে সময় কুমিরের চামড়ার চাহিদা খুব বেড়ে যায়। কারণ-টাকাওয়ালাদের পায়ের জুতা, প্যান্টের বেল্ট অথবা মানিব্যাগে এই কুমিরের চামড়ার খুব চাহিদা ছিল। কিন্তু কুমির শিকার চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। জীববিজ্ঞানীরা বলেন, পৃথিবীতে সব প্রাণীর বিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে কুমিরের পূর্ব পুরুষ যেমন ছিল আজও তেমনি একই হিংস্রতা নিয়ে প্রজাতিটি বেঁচে আছে। তো এহেন কুমির শিকার করতে মারাত্মক সাহসী পুরুষদের দরকার হয়। শুধু সাহস থাকলেই তো হবে না। সঙ্গে থাকতে হবে বুদ্ধি। পানির কুমিরকে ডাঙ্গায় টেনে বন্দুকের গুলি মেরে হত্যা করা! পানি থেকে কুমিরকে ডাঙ্গায় উঠানোর জন্য কুমিরের টোপ ইংরেজিতে যাকে বলে বেইট দেওয়া হতো। এই টোপ হিসেবে ব্যবহৃত হতো কালো মানুষের ছোট ছোট বাচ্চাদের।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের ঘটনা এগুলো। তবে মার্কিন মুলুকের সাদা চামড়ার ভদ্রলোকরা এসব ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেও এক পর্যায়ে কিছু মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম দিক বেড়িয়ে আসে। এ নিয়ে যারা কাজ করছেন এমন একজন গবেষককে অরল্যান্ডোর কাছাকাছি অবস্থিত ষ্ট্যানফোর্ড শহরের এক বাসিন্দা জানিয়েছেন যে, ‘এই এলিগেটর বেইট এর ব্যাপারে তার দাদার কাছ থেকে শুনেছেন তিনি। নিগ্রো বাচ্চাদের মায়েরা যখন দিনের বেলায় কাজ করতো অথবা অন্য কোনো কাজে একটু এদিক-ওদিক যেত তখনি ওৎ পেতে থাকা কুমির শিকারিরা নিগ্রোদের বাচ্চাগুলোকে চুরি করতো।’
টাইম ম্যাগজিনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই বাচ্চাগুলোর বয়স থাকতো এক বছর বা এর আশেপাশে। বাচ্চাগুলোকে চুরি করেই একটানে জলাভূমির কোনো নির্জন স্থানে মুরগির বাচ্চার মতো আটকে রেখে দেওয়া হতো। রাত হলেই বাচ্চাগুলোর হাতে বা গলায় দড়ি দিয়ে বেঁধে অগভীর জলায় নামিয়ে দেওয়া হতো। প্রাণের আতংকে শিশুগুলো চিৎকার করতে থাকত। এক পর্যায়ে এই বাচ্চাদের চিৎকার ও দাপাদাপিতে কুমিরগুলো গভীর পানি থেকে তীরের দিকে আসতো। ওদিকে বীর কুমির শিকারিরা বন্দুক নিয়ে বসে থাকতো কোনো সুবিধাজনক স্থানে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাচ্চাটার কপাল ভালো হলে কুমির এসে বাচ্চার সামনে থেমে যেতো আর শিকারি গুলি করে কুমিরটাকে হত্যা করতো। তবে সব বাচ্চার কপাল এতো ভালো হতো না। কোনো কোনো কুমির এক টানে দৌঁড়ে এসে বাচ্চাটাকে কামড় দিয়ে মুখের মধ্যে নিয়ে যখন খেতে শুরু করতো তখন কিছুটা স্থির হলেই মওকা মতো গুলি করে কুমির শিকার করতো শিকারিরা। এরপর কুমিরের দামি চামড়া সংগ্রহ করে নিয়ে যেত। হতভাগ্য কালো শিশুটি তখন হয়তো আধা খাওয়া অবস্থায় কুমিরটির মুখের মধ্যে থাকতো। শিকারিদের ভাষায়- ‘কুমির শিকারের জন্য এসব কালো শিশুদের ‘পিকানিন্নিস’ বলা হতো। এরা মানুষ নামের তুল্য ছিল না। আবার এসব পিকানিন্নিসদের অনেক সময় পাওয়া কঠিন হয়ে যেতো। সেক্ষেত্রে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে তাদের সরবরাহ করার জন্য তাদের মা-বাবাদের কাছ থেকে অর্থ-কড়ির বিনিময়ে সংগ্রহ করা হতো। শিশুটির মূল্য বাবদ তার মা-বাবাকে দু’ ডলার দেওয়া হতো।’
গবেষকরা বলছেন, বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে আমেরিকান সাদারা বিষয়গুলোকে আড়াল করার চেষ্টা করলেও, একাধিক সূত্রে ইতিহাসের পাতা থেকে গবেষকরা এসব তথ্যের যথার্থতা নিশ্চিত করেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম একটি সূত্র হলো, মিশিগানের ফেরিস স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অবস্থিত জিম ক্রো মিউজিয়াম। সেখানে সংরক্ষিত বিভিন্ন হাউজ আর্টিফ্যাক্টস (পোস্টকার্ড, নিকন্যাক, প্রোডাক্ট প্যাকেজিং ইত্যাদি) দেখলে বোঝা যায়, বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে আমেরিকান পপ কালচারে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বর্বরতা কতটা গভীরভাবে মিশে গিয়েছিল। ফ্লোরিডার এক বাসিন্দার বাড়িতে একটি ছবি পাওয়া যায়। যেখানে দেখা যায়-নয়টি পিকানিন্নিস। নীচে লিখা ‘এলিগেটর বেইট’।
এভাবেই আমেরিকার সাদা লোকেরা যুগে যুগে কালো মানুষের স্বাধীনতা চুরি করেছে। তারা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে এই আত্মসাতের সুবিধা ভোগ করেছে। যার পক্ষে কোনো রকম নৈতিক গ্রহণযোগ্যতাই নেই। অথচ তাদের পক্ষে হাকিম, জুরি, বন্দুক, আইন সবই রয়েছে। সব ক্ষমতাই তাদের। কিন্তু এই ক্ষমতা অপরাধীর ক্ষমতা। একে ভয় করা যায়। শ্রদ্ধা করা যায় না। সাদাদের সমাজে নীতিকথার বুলি কপচানো হয়। তবে সেসব অনুসরণ না করাটা কালোদের দমন করার আরেকটা ফন্দি। এই যে কালোদের উপর অতীত অত্যাচার- আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা, পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলা, শিশুহত্যা, ধর্ষণ, মৃত্যু, লাঞ্ছনা, অহোরাত্রি ত্রাস! সে এমন ত্রাস! যা মজ্জার গভীর পর্যন্ত চলে যায়। তার নিজ জীবনের মূল্য সম্বন্ধে সংশয় হয়। চারপাশে সবাই সেটার মূল্য অস্বীকার করে। নারী, স্বজন, সন্তান, যাদের রক্ষা করা প্রয়োজন ছিল, কিন্তু রক্ষা করতে পারেনি। ওদের জন্য বেদনা; ক্রোধ আর ঘৃণায় মাথায় খুন চেপে যায়। সাদা মানুষের প্রতি এমন গভীর ঘৃণা জন্মায় যে- সেই ঘৃণা উল্টো নিজের দেশের সাদা মানুষের ওপর এসে পড়ে। যার ফলে সবরকমের ভালোবাসা, বিশ্বাস, আনন্দ অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে যা হওয়ার তাই হয়।
কালো মানুষরা অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। বেঁধে যায় গৃহযুদ্ধ। ১৮৬০ সালে সিভিল ওয়ারের ঠিক আগে আমেরিকাতে কালোদের জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছিল মাত্র ৪৪ লাখে। ১৮৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১৩তম সংশোধনে অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে কাগজে-কলমে আমেরিকায় দাস প্রথার বিলুপ্তি ঘটলেও, বাস্তবের চিত্রটা ছিল একদমই আলাদা। নামেই দাস প্রথার বিলোপ হয়েছিল। বাস্তবে দাস প্রথা ভালোই চলছিল বিলোপের আড়ালে। অবৈধ উপায়ে ঠিকই কালো মানুষরা এসে ভরতে থাকে আমেরিকা মহাদেশে।
আজ আমেরিকায় কালোদের অবস্থা নিঃসন্দেহে অনেক উন্নত। শিক্ষা, রাজনীতি ও আর্থিক সবক্ষেত্রেই নেতৃত্ব দিতে পারে। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তারই এক জ্বলন্ত উদাহরণ। তবে ভয়াবহ ফাঁকও রয়ে গেছে। সাদারা সামাজিক শিষ্টাচার রীতিনীতি মেনে চলে বলে দাবি করা হলেও; সাদাদের জগতে বসবাস করে কালো সমাজের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তার ফলে তাদের মাঝে এই দাবির প্রতি বিন্দুমাত্র আস্থা সৃষ্টি করা আজও সম্ভব হয়নি। কালোদের নিজের অবস্থানই তর্কাতীতভাবে প্রমাণ করে যে, তারা যেসব নীতি-রীতি মেনে চলে, সাদা চামড়ার লোকেরা ওসব রীতিনীতি মেনে চলার ধারে কাছেও নেই।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক। এম.ফিল স্কলার, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
কেএসকে/জিকেএস