পুঁতির শোপিস তৈরি করেই সাবলম্বী এই গ্রামের নারীরা

উপজেলা প্রতিনিধি উপজেলা প্রতিনিধি মিরসরাই (চট্টগ্রাম)
প্রকাশিত: ০৩:৪৩ পিএম, ২০ নভেম্বর ২০২২

কেউ তৈরি করছেন পাখি-ফুল, কেউ করছেন পুঁতির ব্যাগ। এই গ্রামের নারীরা সবাই ব্যস্ত পুঁতি দিয়ে নানান রকম শোপিস তৈরি করতে। গ্রামটি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। এখানকার নারীরা অন্যের মুখাপেক্ষী না হয়ে এখন নিজেরাই সংসারের হাল ধরেছেন। অনেকের দুঃখে ভরা জীবনের গল্প পরিবর্তন হতে শুরু করেছে।

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের ফ্যাশন ডিজাইন ও ক্রিস্টাল শোপিস ও ডেকোরেটেড কেন্ডেল মেকিং (মোমবাতি) ট্রেডে প্রশিক্ষণ নিয়ে সাবলম্বী হয়েছেন গ্রামের অনেক নারী। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘উপজেলা পর্যায়ে নারীদের জন্য আয়বর্ধক (আইজিএ) প্রশিক্ষণ’ শীর্ষক প্রকল্পের মিরসরাইয়ে ১৭তম ব্যাচে ফ্যাশন ডিজাইন এবং ক্রিস্টাল শোপিচ ও ডেকোরেটেড কেন্ডেল মেকিং (মোমবাতি) ট্রেডে এই পর্যন্ত প্রায় ৯০০ নারী প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। আছমা নূরী ও রিমা রাণী দু’জন ট্রেইনার তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন।

বর্তমানে ১৬ ও ১৭ তম ব্যাচে প্রশিক্ষণ চলছে। উপস্থিতির হারে প্রতিদিন যাতায়াত খরচ বাবদ প্রশিক্ষণ শেষে প্রতিজনকে ২০০ টাকা করে ১২ হাজার টাকা প্রদান করা হয়। তারা এখানে তৈরি করেন বিভিন্ন ধরনের ক্রিস্টাল পুঁতির শোপিচ। যা দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যায়। এসব শোপিস তৈরিতে ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন আকৃতির পুঁতি। কোনোটির নাম ছক্কা পুঁতি, পৃথিবী পুঁতি, পার্ল পুঁতি, লাউ পুঁতি, কামরাঙ্গা পুঁতি, কোনোটি আবার ডায়মন্ড পুঁতি। এর সঙ্গে আরও দরকার হয় রগ সুতা।

পুঁতি দিয়ে ১০০- ১০ হাজার টাকার পণ্যও তৈরি করা হয়ে থাকে। যেখানে পুঁজির চেয়ে তিনগুণ বেশি লাভ। ফল, হাতের ব্যাগ, টিস্যু বক্স, ওয়ালমেট, পাখি, ফুল, ফলদানি, টুপিসহ বিভিন্ন শোপিস তৈরি করছেন নারীরা। উদ্যোক্তারা তৈরীকৃত এসব পণ্য স্থানীয় দোকানের পাশাপাশি অনলাইনে বিক্রি করেন।

স্বাবলম্বী ছেনোয়ার বেগম জাগো নিউজকে জানান, সংসার জীবন ১২ বছরের। এরপর ৩ কন্যা সন্তানসহ তাকে স্বামী ছেড়ে চলে যান। অভাব অনটন আর দুঃখ কষ্টে জীবনধারনের পাশাপাশি সন্তানদের পড়ালেখা ও পরিবারের দায়িত্ব নিজ কাঁধে নেন ছেনোয়ারা বেগম। নিজ উদ্যোগে সেলাইয়ের প্রাথমিক কিছু কাজ শেখেন। পরবর্তীতে মিরসরাই উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে পরিচালিত ‘ইনকাম জেনেরেটিং এ্যাকটিভিটিজ’ (আইজিএ) প্রকল্পের অধীনে তিন মাসের সেলাই প্রশিক্ষণ নেন। সেখান থেকে ছেনোয়ারা বেগমের দুঃখে ভরা জীবনের গল্প পরিবর্তন হতে শুরু করে। প্রথমে গ্রামের নারীদের কাপড় সেলাই করলেও এখন স্থানীয় বারইয়ারহাট পৌরসভায় নিতুল টেইলার্স নামে তার নিজের একটি দোকান রয়েছে। যেখানে আরও ৫ জন নারীর কর্মসংস্থান করতে পেরেছেন তিনি। পাশাপাশি নারীদের সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ দেন ছেনোয়ারা বেগম। প্রতি মাসে তার ইনকাম ২৫-৩০ হাজার টাকা। নিজের উপার্জিত অর্থ দিয়ে বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। বাকি দু’জন পড়ালেখা করছে। ছেনোয়ারা বেগমের মতো সহ্রাধিক নারী ফ্যাশন ডিজাইন এবং ক্রিস্টাল শোপিস ও ডেকোরেটেড কেন্ডেল মেকিং (মোমবাতি) ট্রেডে প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন সাবলম্বী হয়েছেন।

jagonews24

জানা গেছে, শুধু ছেনোয়ারা বেগম নয় তার মতো সাবলম্বী হয়েছেন আরও অনেকে। মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় কর্তৃক পরিচালিত ‘ইনকাম জেনেরেটিং এ্যাকটিভিটিজ’ (আইজিএ) প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, প্রশিক্ষণার্থীরা ২টি কক্ষে হরেক রকমের পুঁতি ও রগ সুতা দিয়ে বিভিন্ন ক্রিস্টাল শোপিস তৈরির কাজ করছেন। সপ্তাহে ৫ দিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। পাশের কক্ষে ব্লক, বাটিক, হ্যান্ডপ্রিন্ট, সেলাই, হাতের বুটিকসের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলতেছে। সেখানেও হাতে কলমে সেলাই প্রশিক্ষণ, বুটিকসের কাজ শেখানো হচ্ছে।

ক্রিস্টাল ডিজাইনার ও উদ্যোক্তা আর্জিনা আক্তার সুবর্ণা স্থানীয় নিজামপুর সরকারি কলেজের বিবিএস ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী। পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি ক্রিস্টাল শোপিস ও ডেকোরেটেড কেন্ডেল মেকিং (মোমবাতি) ট্রেডে ১৩ ব্যাচে প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে বাসায় ক্রিস্টালের বিভিন্ন শোপিস তৈরির কাজ শুরু করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পেজ খুলে নিজ হাতে তৈরি ক্রিস্টালের শোপিস নিজেই বিক্রি শুরু করেন। প্রথমে অর্ডার কম থাকলেও এখন প্রতি মাসে ১০-১২ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি করেন তিনি। এখন বড় উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন সুবর্ণা।

তিনি বলেন, উপজেলার স্থানীয় বাজারগুলোতে বিভিন্ন ডিজাইনের পুতি ও সুতা পাওয়া যায় না। মিরসরাই পৌর বাজার অথবা চট্টগ্রাম শহর থেকে কিনে আনতে হয়। স্থানীয় ভাবে ক্রিস্টাল শোপিসগুলোর চাহিদা এখনো কম হলেও অনলাইন মার্কেটে এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। পড়ালেখা শেষ করে আরও বৃহৎ পরিসরে ক্রিস্টাল শোপিস নিয়ে কাজ করতে চান সুবর্ণা।

ক্রিস্টাল শোপিচ ও ডেকোরেটেড কেন্ডেল মেকিং (মোমবাতি) ট্রেডের প্রশিক্ষক আছমা নূরী বলেন, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে পরিচালিত ‘ইনকাম জেনেরেটিং এ্যাকটিভিটিজ’ (আইজিএ) প্রকল্পের অধীনে প্রতি ব্যাচে ২৫ জন করে ৩ মাসের কোর্স শেষে সনদ ও যাতায়াত ভাতা প্রদান করা হয়ে থাকে। প্রশিক্ষণে কলেজ শিক্ষার্থী ও সমাজের অবহেলিত নারীদের আগ্রহ বেশী লক্ষ্যনীয়। প্রশিক্ষণ শেষে সবাই নিজ নিজ উদ্যোগে উদ্যোক্তা হচ্ছেন। যার ফলে বঞ্চনার শিকার থেকে মুক্তি পাওয়ার পাশিপাশি আর্থিক ভাবে সাবলম্বী হচ্ছেন নারীরা। প্রতি উদ্যোক্তা প্রতিমাসে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকার ক্রিস্টাল শোপিস বিক্রি করেন বলে জানান তিনি।

উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মেহের আফরোজ জাগো নিউজকে বলেন, নারীদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘উপজেলা পর্যায়ে নারীদের জন্য আয়বর্ধক (আইজিএ) প্রশিক্ষণ’ শীর্ষক প্রকল্প চালু করা হয়। যার মাধ্যমে নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হচ্ছেন। প্রশিক্ষণ শেষে ব্যবসার জন্য কেউ যদি ঋণ নিতে চান তাহলে আত্মকর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের আওতায় আমার দপ্তর থেকে ঋণ দেওয়া হয়ে থাকে। প্রশিক্ষণ শেষে উদ্যোক্তারা সাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা আনয়নেও ভূমিকা রাখছেন।

এম মাঈন উদ্দিন/ কেএসকে/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।