গল্পটি ভালোবাসার


প্রকাশিত: ০৫:৩৪ এএম, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬
মডেল : আলভি ও ইকরা

রাজধানী শহর। পুরনো অভিজাত এক এলাকায় ট্র্যাফিক সিগন্যালে আটকে থাকা বাসে বসে ঝিমুচ্ছে ঋভু। বাসের হাল্কা দুলুনি, জ্যাম, ঠাণ্ডা বাতাস– সবমিলিয়ে কেমন যেন বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। সিটটা পড়েছে একদম জায়গামতো– জানালার পাশে।
সিগন্যাল ছেড়ে দিতেই হেল্পারের হাঁক, `ওই শঙ্কর যারা নামবেন গেটে আসেন গেটে আসেন! ওস্তাদ নামার আছে !`
উঠে দাঁড়ালো ঋভু। আজ ভার্সিটির প্রথম ক্লাস, যাকে বলে ওরিয়েন্টেশন। কিঞ্চিৎ নার্ভাস সে, মুখের ভাবভঙ্গীতে নির্বিকার। যেন ব্যাপারই না। বাস থেকে নেমে ইতিউতি তাকাতেই ভার্সিটির বিল্ডিঙটা নজরে পড়ল ওর। বিল্ডিঙটার ৪র্থ তলায় যেতে হবে ওকে।
লিফট থেকে বের হতেই ঋভুর মনে হল বাণিজ্য মেলায় চলে এসেছে সে। ছেলেমেয়েতে ভর্তি পুরো হলওয়ে। কোনোরকম একটু দাঁড়ানোর জায়গা বের করে স্থির হওয়ার চেষ্টা করতেই এক ভদ্রলোকের শান্ত আহ্বান,
`সবাই কনভেনশন রুমে ঢুকে পড়ুন প্লিজ। একটু পরেই আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে।`
হাল্কা ঠেলাঠেলি করতে করতে ভেতরে ঢুকে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল ঋভু। ছেলেদের দিক থেকে একদম এক প্রান্তে বসেছে সে। ওর পর থেকেই মেয়েদের সারি শুরু। পাশেই চুপচাপ, শান্ত প্রকৃতির একটা মেয়ে বসা। একটু মোটাসোটা কিন্তু দেখতে অসম্ভব কিউট। কথা বলার ইচ্ছে থাকলেও বারদুয়েক চোখাচোখি আর জাস্ট একটু হাসি বিনিময় ছাড়া কিছুই হচ্ছে না।
ধুরও! হতাশ ঋভু এবার মন দিল মঞ্চের দিকে।
কি বলা হচ্ছে তাই বরং শোনা যাক।
মিনিট চল্লিশেকের অনুষ্ঠানের পর প্রথম ক্লাস। সদ্য পরিচিত বন্ধুদের সাথে ক্লাসে ঢুকেই অবাক ঋভু। আরে ! সেই মেয়েটা তো এই ক্লাসেই। যাক, এবার মনে হয় কথা বলার একটা সুযোগ পাওয়া যাবে !
পরিচিতিপর্ব চলতে চলতে মেয়েটার কাছে এলেও সেই একই কাহিনী- হাসি, আর কিচ্ছু না। এবং যথারীতি ঋভু আবার হতাশ। তবে একটা কাজ হয়েছে অবশ্য। মেয়েটার নাম জানা গেছে। মৌ।
ধুরও! স্যার চলে এসেছে, ক্লাস শুরু। আজ আর কথা হল না। কিন্তু আগামীকাল মিস করা যাবে না। যেভাবেই হোক, কথা বলতে হবে। ঋভু এবার আত্মপ্রত্যয়ী।


কিঞ্চিৎ লাজুক, চুপচাপ প্রকৃতির মেয়েটার নাম মৌ।
মফস্বলের মেয়ে। বাবা একটা নার্সিং হোমের মালিক। মেয়েটা একটা ভাল ভার্সিটি থেকে পড়াশোনা শেষ করবে এই ইচ্ছায় মেয়েকে রাজধানীর এই ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। ওরিয়েন্টেশনের দিন পাশে বসা ছেলেটার ভাবভঙ্গি দেখে মেয়েলি বুদ্ধিমত্তায় মৌ ঠিকই বুঝতে পেরেছে যে ছেলেটা কথা বলতে চায়। কিন্তু নিজে তেমন উৎসাহবোধ না করায় জাস্ট দায়সারা হাসি দিয়ে ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছে সে।  
তবে ওরিয়েন্টেশন শেষে প্রথম ক্লাসে গিয়েই মৌ অবাক। আরে! একদম `পড়বি তো পর মালির ঘাড়ে` অবস্থা ! সেই ছেলেতো এই একই ক্লাসে ! বাধ্য হয়েই পরিচিত হতে হল ছেলেটার সাথে। ওর নামটা সুন্দর। ঋভু। আনকমন। ছোট্ট।
ক্লাস চলতে চলতেই ছেলেটা সম্পর্কে একটু একটু করে অবগত হতে শুরু করল মৌ। পূর্বাপর পরীক্ষাগুলোয় ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্টের দরুন ঋভু নামের ছেলেটা ক্লাসের মনিটর হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছে। এখন থেকে যাবতীয় বিষয় নিয়ে ওর সাথেই কথা বলতে হবে সবার। কথা বলার তেমন ইচ্ছে না থাকলেও সম্পর্কটা তো রাখতেই হবে, ভাবল মৌ।
এদিকে `ক্লাস মনিটরের কাছে সবার ফোন নাম্বার দিতে হবে` স্যারের এই আদেশে সবার নাম্বার নিতে নিতে ঋভু মনে মনে খুশি হয়ে উঠলো। `ফোন না দেই, নাম্বারটা তো থাকবে। পরেরটা পরে দেখা যাবে...` ভাবল সে।


কেটে যাচ্ছে দিন। পড়ার চাপও বাড়ছে। ভার্সিটি লাইফ। ঋভু ভেবেছিল যে তেমন কোন ব্যাপারই না, এখন দেখে উল্টোটা! সবাই মোটামুটি বেশ সিরিয়াস। মনিটর হিসেবে ক্লাসের সবার সাথেই ভাল কানেকশন হয়ে গেছে ঋভুর। এমনকি মৌয়ের সাথেও। প্রায়শই পড়াশোনার নানা বিষয় নিয়ে কথা বলে ওরা। এবং ক্লাসের পরিসর ছাড়িয়ে তা চলে যায় ফোনেও।
ঋভুর প্রতি মৌয়ের ধারণাও বেশ খানিকটা বদলে গেছে।
`নাহ, ছেলেটা খারাপ না`, এটা মৌয়ের ভাবনা।
আর ঋভুর ভাবনা, `মেয়েটাকে যতটা মুডি ভেবেছিলাম, অতটা না`।
তবে মৌয়ের পার্সোনালিটির প্রশংসা করে সবাই। নিজের ওজন বুঝে চলে মেয়েটা।

মেঘে মেঘে বেলা হয়। আর কথায় কথায় কাছে আসা হয়। প্রায় প্রতিদিনই কথাবার্তার সূত্রে মৌ–ঋভু একে অপরের বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে ইদানীং। পড়াশোনার বিষয় ছাপিয়ে আরও নানা বিষয় নিয়ে কথা হয় ওদের। ধ্যানধারণা, চিন্তাভাবনা শেয়ার করে ওরা। ঋভুর কথাগুলো বেশ ভাল লাগে মৌয়ের। ছেলেটা বেশ গুছিয়ে বুঝিয়ে শুনিয়ে কথা বলতে পারে। কাছের বন্ধু ভেবে নিজের কিছু সমস্যার কথা বলেছে সে ঋভুকে। এবং ঋভু সেসবের কিছু চমৎকার সমাধান বের করে দিয়েছে।
ঋভুর দিক থেকে ব্যাপারটা কিঞ্চিৎ ভিন্ন। মৌয়ের প্রতি ওর একটা রেস্পেক্ট কাজ করে। কিন্তু কেন, নিজেও জানে না। তবে ইদানীং সেই জায়গাটা পরিবর্তিত হয়ে অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে। ঋভু বুঝতে পারছে না যে কি করবে... অদ্ভুত। আচ্ছা, কাউকে পছন্দ করাটা কি দোষের কিছু? স্ত্রেইট ফরওয়ার্ডখ্যাত ঋভু জীবনে এই প্রথমবার কনফিউজড।
`বলব? যদি কিছু মনে করে? যদি বলে আমি তো তোমাকে এভাবে ভাবিনি কখনও, তখন? পরে যদি কথা বলা বন্ধ করে দেয়? ধুরও, আজিব... কি করব এখন?`  ভাবছে ঋভু।
সকল সমস্যার ইনস্ট্যান্ট সমাধান বন্ধুবান্ধবের কাছে নিহিত – এটা চিরন্তন সত্য একটি কথা। তো বন্ধুদের সাথে ব্যাপারটা শেয়ার করতেই ঋভুকে খুব সহজ সমাধান ধরিয়ে দিল সবাই। সেটা কি?

`আরে ব্যাটা বলে ফেল। হয় ইয়েস নয়ত নো, কিছু একটা তো জানবি। ভালবাসা তো আর পাপ কোন কিছু না। ডিরেক্ট বলে ফেল... কী আছে জীবনে ব্যাটা!`
আসলেই তো। ঋভু ভাবে। বলেই ফেলি বরং। কি আর হবে। হয়ত মাইন্ড করবে। যদি না করে দেয় তো কিছুই করার নেই। নিজেকে তো বুঝ দিতে পারব যে অ্যাট লিস্ট বলতে পারছি... সাহস সঞ্চার করে ঋভু। যা আছে কপালে, কালকেই বলে ফেলতে হবে। সিদ্ধান্ত নিয়েই আবার চিন্তায় পড়ে গেল ঋভু। কালতো শুক্রবার। পরশু ক্লাসে বলি। নাহ, কালকেই বলে ফেলি। পরশুরটা পরশু দেখা যাবে...   


ছুটির অলস বিকেল। হাল্কা ঠাণ্ডার এই বিকেল বেলায় একটু গড়িয়ে নেয়ার ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু ঋভু আছে দুশ্চিন্তায়। হাতে মোবাইল। ডায়াল লিস্টে মৌয়ের নাম্বার। কল দেব? নাকি দেব না?
ধুরও... দিয়েই ফেলি।
যেই ভাবা সেই কাজ। কল দিয়ে ফেলল ঋভু। একটা রিং হতেই কল রিসিভ করল মৌ। মিষ্টি প্রলম্বিত সুরে সেই `হ্যালো` শুনেই গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে ঋভুর। স্বর বেরুচ্ছে না। ওপাশে মৌ হ্যালো হ্যালো করেই যাচ্ছে। অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে কথা শুরু করল ঋভু। কিন্তু গলা কাঁপছে।
`এই তোমার কি হয়েছে? গলা কাঁপছে কেন? আর ইউ ওকে, ঋভু?`
মৌয়ের প্রশ্ন শুনে আবারো শক্ত ঋভু। এবার কি বলবে? নাহ, আর পারছি না। যা বলার হয় এখুনি, নয়ত কখনই না। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ঋভু।  
-    মৌ...
-    বল...
-    তোমাকে একটা কথা বলতে পারি? যদি কিছু মনে না করো
-    আরেহ না... বল। সিরিয়াস কিছু?
-    বলতে পারো। আবার নাও বলতে পারো। কিন্তু বলাটা জরুরী।
-    আচ্ছা বল।
-    মৌ
-    হুমম
-    আমি তোমাকে ভালোবাসি।
-    (ওপাশে অখণ্ড নীরবতা)
-    আমি জানি না কথাটা তুমি কিভাবে নেবে? কিন্তু আসলেই আমি তোমাকে ভালোবাসি। কথাটা এতদিন বলতে চেয়েও বলতে পারিনি। কিন্তু আজ বলে ফেললাম। আমি সরি। এক্সট্রিমলি সরি, রাখি।
লাইনটা কেটে দিয়েই মনে হল বুকের ওপর থেকে জগদ্দল পাথর সরে গেছে। যা হবার তাই হবে, বলতে তো পেরেছি, নিজেকেই যেন বলে ঋভু। ভাবনার সাগরে ডুব দিতে গিয়েও পারল না। কারণ আবারো ফোনটা বেজে উঠেছে। না, মৌ না। বন্ধুর ফোন। চায়ের দোকানে যেতে হবে। চায়ের সাথে আজ অনেক কিছু দরকার।


দুইদিন কেটে গেছে। ক্লাসে দেখা হলেও একটা কথাও বলেনি মৌ। এমনকি ফোন পর্যন্ত না। কোন যোগাযোগ নেই বলা যায়। ঋভুর ঘুম হচ্ছে না। কোনকিছু ঠিকমত করতে পারছে না সে। না আড্ডা, না পড়াশোনা, না ক্লাস, না অন্যকিছু। একটু পর পর ফোনের স্ক্রিনের দিকে চোখ, আর অপেক্ষা... শুধু একটা উত্তরের।
তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় হঠাৎ মৌয়ের কল। বন্ধুবান্ধবের সাথে আড্ডায় মত্ত ঋভু নিজের ফোন স্ক্রিনে মৌয়ের নাম্বার দেখে চমকে গেল। মুহূর্তেই গলা শুকিয়ে কাঠ। কাঁপতে কাঁপতে রিসিভ বাটন চেপে কানে ঠেকাতেই মৌয়ের সেই মিষ্টি নরম প্রলম্বিত কণ্ঠ ভেসে এলো, `কেমন আছ?`
সারা দুনিয়া যেন আজ এলোমেলো। এই কণ্ঠ শোনার জন্যই তো ঋভু পাগল। এই প্রলম্বিত সুরের জন্যই তো ঋভুর সবকিছু। ঋভুর মনে হল দুনিয়ার সব সুখ তো আসলে এখানে। এই মায়াভরা কণ্ঠে। এক অদ্ভুত প্রশান্তি ঘিরে ধরল তাকে। স্বাভাবিক কথাবার্তা কিছুক্ষণ। একসময় কথার ভাণ্ডার ফুরিয়ে এলো। এবার বিদায় নেবার পালা। কিন্তু ঋভু এখনও জানে না, মৌ কী ডিসাইড করেছে।
ফোন রেখে দেয়ার ঠিক আগে মৌ নিজেই প্রসঙ্গটা তুলল।
অতি সহজ, স্বাভাবিক কিছু কথা, কিন্তু উত্তর দিতে গিয়ে নিজের ভেতরে দানা বাঁধছে অদম্য আবেগ। সেই আবেগের দোলা বেশ ভালভাবেই টের পাচ্ছে ঋভু।  
`তুমি আমাকে সরাসরি বলেছ, ভাল লেগেছে আমার কাছে। আমার সব কিছুই তুমি জানো। তোমার কাছে কিচ্ছুই লুকাইনা আমি। কেন, নিজেও জানি না। তোমাকে বিশ্বাস করতে ভাল লাগে আমার। হয়ত তাই... তোমার কাছে আমার শুধু একটা কথা, কোনদিন, কোন অবস্থাতে, কখনও আমাকে ছেড়ে যাবে না। ঠিক এভাবেই সবসময় আমার পাশে থাকবে তুমি, এটাই আমার চাওয়া। আর কিচ্ছু না...।`

মৌয়ের মিষ্টি নরম কণ্ঠে `ভালবাসি` কথাটা শুনে আনন্দে রীতিমত আত্মহারা হয়ে উঠলো ঋভু। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। মৌ রাজি হয়েছে! মৌ বলেছে তাকে এই কথা!
পুরো চায়ের দোকান কাঁপিয়ে ঋভুর ভরাট গলা থেকে উৎসারিত হল সেই অমিয় শব্দ, `ভালোবাসি`। মৌ-ঋভুর গল্প সেই থেকে শুরু।

এইচএন/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।