ফ্যান ধীরে ঘুরলে কি বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়?

শেখ আনোয়ার
শেখ আনোয়ার শেখ আনোয়ার , বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত: ০৩:০৫ পিএম, ২১ অক্টোবর ২০২২

বৈশ্বিক সংকটকালে অকটেন, ডিজেল, পেট্রোল জ্বালানির দাম অসহ্য বেড়ে গেছে। এদিকে বেড়েছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের কবলে পড়েছে রাজধানীসহ সারাদেশ। ওদিকে আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর গুঞ্জনও শোনা যায়। তাই বিদ্যুৎ খরচ কমানো নিয়ে কমবেশি আমরা সবাই উদ্বিগ্ন। এমন পরিস্থিতিতে দেশবাসীকে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন আমাদের রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘বিশ্বব্যাপী বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেড়েছে, কয়লা প্রায় পাওয়া যাচ্ছে না। তাই সবাইকে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে হবে।’ বর্তমান বিদ্যুৎ সংকট সব সময় থাকবে না বলেও জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ছিল সব ঘরে বিদ্যুৎ দেওয়ার, আমরা দিয়েছি। কিন্তু বিশ্বে জ্বালানি সংকট চলছে, অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়েছে।’ তাই আসুন, আমরা সবাই মিলে বিদ্যুৎ সংকটকালে ধৈর্য ধরে বিদ্যুৎ ব্যবহারে যথাসাধ্য সাশ্রয়ী হই।

jagonews24

আমরা বৈদ্যুতিক ফ্যান চালাই বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালতে। তবে আমরা তো আর সব সময় একই গতিতে বৈদ্যুতিক পাখা বা ফ্যান চালাই না। গরম যখন অসহ্য মাত্রায় বেশি হয় কেবল তখন এবং যখন বাইরে থেকে ঘর্মক্লান্ত হয়ে ফিরি তখন ফ্যানটা পূর্ণগতিতে ছেড়ে দেই। ব্যস! শরীরের ঘাম জুড়িয়ে এলে, শরীরটাও ঠান্ডা হয়ে এলে, তখন আবার ফ্যানের গতিটা একটু কমিয়ে দিই।

ফ্যান পূর্ণগতিতে চললে বাতাসটা গায়ে জোরে জোরে লাগে বটে! কিন্তু অসুবিধাও একটু হয়। আবার গরমের দিন সারারাত ধরে ফ্যান ছেড়ে রাখতে হলেও আমরা গতিটা একটু কমিয়েই রাখি। অর্থাৎ পারতপক্ষে, ফ্যান অপেক্ষাকৃত কম বা মধ্যম গতিতেই চালান সবাই। ফ্যানটা কম গতিতে বাতাসও তুলনামূলকভাবে কম পাওয়া যায়। তাহলে স্বভাবতই বিদ্যুৎ খরচও কম হওয়ার কথা। কিন্তু বিদ্যুৎ খরচ আদৌ কি কম হয়? প্রশ্ন উঠেছে, ফ্যান ধীরে ঘুরলে বিদ্যুৎ খরচ কম হয় কি? আর জোরে ঘুরলে বিদ্যুৎ খরচ কি বেশি হয়? এ নিয়ে ঘরে-বাইরে বিতর্কও কম হয় না। প্রশ্নটা এ সময়ে নতুন করে ভেবে দেখার মতো বৈকি!

jagonews24

দেখা যাক, প্রকৃত অবস্থাটা নিয়ে পদার্থ বিজ্ঞানীরা কী বলেন? আমরা গতি নিয়ন্ত্রণ করি রেগুলেটরের সাহায্যে। রেগুলেটরের কাঁটা ঘুরিয়ে এক বা দুই নম্বরে রাখলে ফ্যান চলে ধীরগতিতে। আবার রেগুলেটরের কাঁটা ঘুরিয়ে পাঁচ নম্বরে দিলে ফ্যান চলে পূর্ণগতিতে। কারণ হচ্ছে রেগুলেটরের ভেতরের রোধ বা রেজিস্ট্যান্স ব্যবস্থা। রেগুলেটরের কাঁটা যখন এক বা দুই নম্বরে দেওয়া হয় তখন রোধ শক্তি বেশি থাকে। অর্থাৎ মূল সরবরাহ থেকে বিদ্যুৎ প্রবাহ রেগুলেটরে এসে রোধের সম্মুখীন হয়। ফলে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ প্রবাহ রেগুলেটরের ভেতর এসেছে, তার তুলনায় অনেক কম প্রবাহ ফ্যানে যায়। কাজেই ফ্যানও ঘোরে ধীরগতিতে।

আবার রেগুলেটরের কাঁটা যখন পাঁচ নম্বরে দেওয়া হয় তখন রেগুলেটর হয় রোধমুক্ত। ফলে যতটা বিদ্যুৎ প্রবাহ রেগুলেটরে আসছে ততটাই সরাসরি ফ্যানে চলে যাচ্ছে। সুতরাং ফ্যানটাও ঘুরছে পূর্ণগতিতে। তাহলে হিসাবটা তো অতি সহজ হয়ে গেল। ফ্যান ধীরে চললে যে কম বিদ্যুৎ নিচ্ছে। আবার জোরে ঘুরলে সে সত্যিকার প্রয়োজনমতো বিদ্যুৎ টানছে। অতএব, ফ্যান আস্তে আস্তে চললে কম বিদ্যুৎ খরচ হবে, জোরে জোরে ঘুরলে বেশি বিদ্যুৎ খরচ হবে এটাই কি স্বাভাবিক নয়?

jagonews24

কিন্তু না। এর মধ্যে আরও একটা কিন্তু আছে। রেগুলেটরের মধ্যে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ এসে পৌঁছেছে তার সবটুকুই মিটার পেরিয়ে আসতে হচ্ছে। সুইচ অন করার সঙ্গে সঙ্গে ফ্যানটা পূর্ণগতিতে চালানোর জন্য যে বিদ্যুৎ প্রবাহের দরকার, তার সবটুকুই মিটার হয়ে তারপর চলে আসছে সুইচ, তারপর রেগুলেটর হয়ে যাচ্ছে ফ্যানে। সুইচ থেকে আসছে একেবার রেগুলেটর পর্যন্ত। তারপর রেগুলেটর থেকে বিদ্যুৎ প্রবাহের পরিমাণ প্রয়োজনমতো নিয়ন্ত্রণ করে নিচ্ছেন।

যখন ফ্যানটা ধীরে ধীরে চালাচ্ছেন তখন বিদ্যুৎ প্রবাহ অনেকটা বাঁধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। তার মানে বিদ্যুৎ জমা থেকে যাচ্ছে রেগুলেটরের মধ্যে। এই থেকে যাওয়া অবশিষ্ট বিদ্যুৎ প্রবাহ কিন্তু পেছনে ফিরে গিয়ে একদম বিদ্যুৎ মিটার পর্যন্ত গিয়ে যদি জমা হতো, কিংবা মিটারের চলাচল গতি পরিমাণমতো থামিয়ে দিতে পারতো, তাহলে নিশ্চয়ই বিদ্যুৎ খরচের হিসাবটা কমে আসতো। কিংবা যদি এমন হতো যে, যতক্ষণ এই বাধাপ্রাপ্ত বিদ্যুৎ রেগুলেটরের মধ্যে থাকছে ততক্ষণ নতুন বিদ্যুৎ প্রবাহ আর আসছে না, তাহলেও মিটারের বিদ্যুৎ খরচের হিসেবটা কম উঠতো।

jagonews24

তবে এ ব্যাপারে রেগুলেটরের মধ্যে জমে থাকা বিদ্যুৎ আপোসহীন। বিদ্যুতের কথা হলো- আমাকে যখন আসতেই হয়েছে তখন কাজ করেই যাবো। সে রেগুলেটরের মধ্যে বসে বসেই নিজেকে পোড়াতে থাকে। এতে রেগুলেটরের কাজ বেড়ে যায়। এভাবে বেশি কাজের জন্য রেগুলেটরের আয়ু কমে যায়। ফলে ফ্যান ধীরে চলার সময় রেগুলেটরে হাত দিলে অনুভব করা যায় রেগুলেটর গরম হয়ে গেছে।

এর মানে ফ্যান ধীরে চালিয়ে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ বাঁচানো যেত, তা রেগুলেটরের মধ্যে আপন মনে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। তাহলে লাভ আর কী হলো? তবে হ্যাঁ, ফ্যানের গতিবেগ কমিয়ে ইনডাকশন পদ্ধতির রেগুলেটর ব্যবহৃত হলে বিদ্যুৎ খরচ সামান্য একটু কম হতে পারে। আমাদের আবাসিক বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই সামান্য বিদ্যুৎ কমার পরিমাণ এতটাই সামান্য যে, হিসেবের মধ্যেই পড়ে না।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক। এম.ফিল স্কলার, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

কেএসকে/এসইউ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।