থুতনির কাজটা কী?


প্রকাশিত: ১০:২৫ এএম, ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

মানুষের মুখমণ্ডলের একেবারে নিচের অংশটার নাম থুতনি। সব মানুষেরই থুতনি থাকলেও প্রত্যক্ষভাবে এর কোনো কাজ পরিলক্ষিত হয় না। কারো কারো থুতনি বেশ শক্ত হলেও, বলা হয়ে থাকে অনেকের থুতনিই দুর্বল। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, এই থুতনির আসলে কাজটা কী, তাহলে এর ভালো কোনো উত্তর পাওয়া যাবে কী? কাউকেই সেভাবে কোনো কাজে থুতনি ব্যবহার করতে দেখা যায় না।

সহজ এই প্রশ্নের জবাব পাওয়াটা আরো জটিল হয়ে ওঠে যখন দেখা যায় বিলুপ্ত সব প্রাণীসহ স্তন্যপায়ীদের মধ্যে কেবল মানুষেরই থুতনি রয়েছে। থুতনির আসলে কাজটা কী- গত শতাব্দীতে যদিও এ প্রশ্নের বেশ কিছু ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা কার হয়েছে, তারপরও এখনো আসলে কেউ নিশ্চিতভাবে জানে না এ অঙ্গের প্রকৃত কাজটা কী।

নর্থ ক্যারোলিনার ডিউক ইউনিভার্সিটির জেমস প্যাম্পুশ বলছেন, ‘থুতনি জিনিসটা আসলেই অদ্ভূত। আর সে কারণেই এটি আমার মনোযোগ কেড়েছে।’ মানুষের থুতনি নিয়ে গত কয়েকবছর ধরে গবেষণা করছেন জেমস। কেবল মানুষেরই কেন থুতনি আছে, সে প্রশ্নের কোনো সদুত্তর এখনো কেউ দিতে পারেননি। আর এ কারণে জেমস নিজেই এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

Chin

থুতনি কী, সে সম্পর্কে আমাদের বেশ ভালো ধারণা থাকলেও এ সম্পর্কে আরো কিছু কথা বলে রাখা ভালো। সহজ কথায়- থুতনি হলো আমাদের চোয়ালের নিচের দিকের বর্ধিত একটা অংশ। অন্য কোনো প্রাণীর থুতনি নেই। উদাহরণস্বরুপ শিম্পাঞ্জির কথা বলে যেতে পারে। এদের চোয়াল ঢালু হয়ে ভেতরের দিকে ঢুকেছে। এমনকি মানুষের বিলুপ্ত পূর্বসূরী নিয়ানডার্থালেরও থুতনি ছিল না।   

বিজ্ঞানীরা আধুনিক মানুষ আর নিয়ানডার্থালের খুলির মধ্যে পার্থক্য খুঁজতেও এই থুতনির আশ্রয় নেন, কারণ নিয়ানডার্থালের থুতনি ছিল না। এ প্রসঙ্গে ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডোর গবেষক জানেতা থায়ের বলছেন, আধুনিক মানুষের শরীরে থুতনি থাকায় বিষয়টি আরো কৌতুহলোদ্দীপক করে তোলে। এ থেকে বলা যায়, নিয়ানডার্থাল আর আধুনিক মানুষের মধ্যে ব্যবহারে বা খাদ্যাভাসে এমন কোনো পার্থক্য ছিল, যার কারণে পরে মানুষের মুখে থুতনি তৈরি হয়।

মানুষের মুখে থুতনি যে কেন আছে সে বিষয়ে কেউ নিশ্চিত না হলেও গত কয়েক দশকে মূলত তিনটা তত্ত্বই বেশি আলোচিত হয়েছে।

এ তত্ত্বগুলোর প্রথমটি প্রস্তাব করে থুতনি সম্ভবত আমাদের চিবাতে সাহায্য করে। এ তত্ত্ব বলতে চায়, চিবানোর সময় অতিরিক্ত যে চাপ পড়ে তা পুষিয়ে নিতেই আমাদের অতিরিক্ত একটা হাড়ের প্রয়োজন। তবে এ তত্ত্ব গ্রহণযোগ্যতা হারায় যখন আমরা একই আকৃতির চিবুকবিশিষ্ট অন্য প্রাণীদের দিকে তাকাই। চিবানোর সময়কার চাপের সঙ্গে আমাদের থুতনির আসলেও যদি কোনো সম্পর্ক থাকতো তাহলে আমাদের আরো অনেক হাড়ের প্রয়োজন হতো জিহবার কাছাকাছি কোথাও, চোয়ালের তলদেশে নয়।

Chin

শিম্পাঞ্জির ক্ষেত্রে ঠিক এ বিষয়টা দেখা যায়। নিচের চোয়ালে, মুখের ভেতরের দিকে এদের অতিরিক্ত একটা হাড় আছে, যা মানুষের নেই। কিন্তু আমাদের থুতনিতে অতিরিক্ত যে হাড়টা আছে তা আমাদের চিবানোর সময় বাড়তি কোনো শক্তি দেয় না।

প্যাম্পুশ আরেক যে বিষয়ের উপর জোর দিচ্ছেন তা হলো- আমরা যে খাবারগুলো খায় সেগুলো চিবানোটা আসলে খুব কঠিন কোনো কাজ নয়। আমরা যে খাবারগুলো মূলত খায়, বিশেষ করে রান্না করা খাবারগুলো, সেগুলোর বেশিরভাগই আসলে নরম খাবার। অর্থাৎ চিবানোর সঙ্গে থুতনির আসলে কোনো সম্পর্ক নেই।

এ কথার সঙ্গে একমত যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব অ্যাবেরডিনের ফ্লোরা গ্রোয়েনিং। পাঁচ বছর আগে একটি কম্পিউটার মডেলের সাহায্যে তিনি দেখার চেষ্টা করেছিলেন চিবানোর সময় আসলে হয়টা কী। আর তা থেকে তিনি চিবানোর সাথে থুতনির তেমন কোনো সম্পর্কের সূত্র পাননি।

অনেকে আবার বলে থাকেন, থুতনি আমাদের কথা বলতে সাহায্য করে। এ তত্ত্বে বলা হয়ে থাকে, কথা বলার সময় আমাদের চোয়ালের নিচের অংশের অতিরিক্ত হাড় থেকে জিহবা বাড়তি শক্তি পেয়ে থাকে। কারণ, কথা বলার কৌশলে আমরাই অনন্য।

এ তত্ত্বের সম্যাটা হলো- কথা বলার সময় আমাদের আদৌ খুব বেশি শক্তির প্রয়োজন হয় না। তাহলে আমাদের বাড়তি শক্তিরই বা প্রয়োজন হবে কেন? আর তার যদি প্রয়োজন হতোই তাহলে সেটি আমাদের চোয়ালের ভেতরের দিকে জিহবার কাছাকাছি কোথাও হওয়ার কথা ছিল।

তৃতীয় তত্ত্বে বলা হয়, থুতনির প্রত্যক্ষ কোনো কাজ না থাকলেও লিঙ্গ নির্ধারণে এর ভূমিকা রয়েছে। এক্ষেত্রে ওরাংওটাং ও হরিণের উদাহরণ দেয়া হলেও মানুষের ক্ষেত্রে তা পুরোপুরি প্রযোজ্য হচ্ছে না। কারণ হিসেবে প্যাম্পুশ বলছেন, আমরা যদি স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলোর দিকে তাকাই তবে দেখবো যে, লিঙ্গ নির্ধারক লক্ষণগুলো যেকোনো একটি লিঙ্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু থুতনির ক্ষেত্রে দেখা যায়, তা স্ত্রী-পুরুষ দুজনের আছে। এমন যুক্তি দেখিয়ে লিঙ্গ নির্ধারক প্রতীকের এ তত্ত্বও মানতে নারাজ তিনি।

প্যাম্পুশ মনে করেন, কেন আমাদের থুতনি রয়েছে তা জানা সম্ভব না। তিনি বলছেন, কেউ যদি বলেন যে তিনি জানেন মানুষের কেন থুতনি আছে, তবে তিনি মিথ্যা বলছেন।

তাহলে তো বিষয়টা দাঁড়ালো আমাদের কেন থুতনি আছে আক্ষরিক অর্থে তার জবাব পাওয়া থেকে আমরা বেশ দূরে রয়েছি। তবে পুরো বিষয়টা অন্যভাবে দেখার একটা সুযোগ আছে।

Chin

ইউনিভার্সিটি অব লোয়ার নাথান হল্টনের মতানুযায়ী, আমাদের মুখমণ্ডলের আকৃতি ছোট হয়ে আসছে। হয়তো এ কারণেই থুতনির জন্ম। চলতি যুগের মানুষের চোয়াল তার বিলুপ্ত পূর্বপুরুষদের চোয়ালের চেয়ে কম শক্ত। মানুষ যখন প্রথম আগুন আবিষ্কার করে রান্না করা খাবার খেতে শেখে তখন থেকে তাদের আর শক্ত চোয়ালের প্রয়োজন হয়নি। অর্থাৎ মানুষের চোয়াল দিনে দিনে দুর্বল হয়েছে।

অন্যান্য ক্ষেত্রেও কিছু পরিবর্তন এসেছে। যেমন অক্ষিকোটরের উপরের দিকে ব্রো ব্রিজ বলে একটা অংশ আমাদের এখন আর নেই এবং গলার হাড়ের নিচে একটা অংশে সামান্য গর্ত মতো আছে। হল্টনের মতে, এর সাথেও আমাদের মুখমণ্ডলের আকৃতি ছোট হওয়ার একটা সম্পর্ক আছে। তিনি বলেন, থুতনির অস্তিত্বের বিষয়টা এ প্রক্রিয়ারই (মুখমণ্ডলের আকৃতি ছোট হওয়া) একটি অংশ। এ পর্যায়ে এসে বলা যায়, আমাদের কেন থুতনি রয়েছে তার জবাব পাওয়া আসলে আমাদের মুখমণ্ডলের আকৃতি কেন দিন দিন ছোট হয়ে আসছে তারই একটা ব্যাখ্যা।

হল্টনের এ ব্যাখ্যায় সমর্থন রয়েছে গ্রোয়েনিংয়ের। তিনি বলছেন, আমাদের চোয়ালের নিচের দিকে একসময় যে শক্তি ছিল সে শক্তি ব্যবহারে সাহায্য করতেই থুতনি হয়তো কাজে লাগতো। তিনি আরো বলেন, নিয়ানডার্থাল এবং হোমো ইরেক্টাসের এতো শক্ত চোয়াল ছিল যে তা আরো শক্ত হতে থুতনির মতো অংশে পৃথক কোনো হাড়ের প্রয়োজন ছিল না। এমনিতেই তাদের চোয়াল এবং হাড় অনেক বেশি শক্ত ছিল। সে তুলনায় আধুনিক মানুষের হাড় দুর্বল। তার মতে, একটা প্রক্রিয়ায় কাজ করতে থুতনি হয়তো কিছুটা সাহায্য করে, তবে তা চোয়ালের শক্তিবৃদ্ধি করে না।

বিষয়টিকে প্রকৌশল বিদ্যার স্প্যানড্রেলের সাথে তুলনা করা যায়। ১৯৭৯ সালে জীববিজ্ঞানী স্টিফেন জে গউল্ড ও রিচার্ড লিওনটিন প্রথম মূলত এভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। স্প্যানড্রেলের আসলে নিজের কোনো কাজ নেই, এর অস্তিত্ব কেবল তার উপরের অংশকে শক্তি দেয়া। এভাবে স্প্যানড্রেল যেমন পরিকল্পিত উপায়ে নির্মিত হতে পারে তেমনি হঠাৎ অন্য কোনো অংশের কারণে বা দুর্ঘটনাবশতও স্প্যানড্রেল তৈরি করা হতে পারে।

প্যাম্পুশ বলছেন, অভিযোজিত হয়ে মানুষ থুতনি পেয়েছে- এ ভাবনা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। সমস্যাটা হলো এটা যে দুর্ঘটনাবশত বা কাকতালীয়ভাবে হয়েছে এমনটাও কেউ প্রমাণ করতে পারবেন না। আমাদের হাতে এখন এমন কিছু নেই যা দিয়ে এমন কিছু প্রমাণ করা যায়।

প্রস্তাবিত কোনো তত্ত্বই যদি ঠিক না হয়ে থাকে এবং স্প্যানড্রেল হাইপোথিসিস যদি প্রমাণ করা না যায়, তাহলে এ বিষয়টা আসলেই বিস্ময়কর তাহলে প্যাম্পুশ এতদিন কেন মানুষের এই থুতনি নিয়ে গবেষণা করে গেছেন।

এর সবেচেয়ে ভালো উত্তর হলো- থুতনির বিষয়টা খুবই অদ্ভুত হলেও এ নিয়ে গবেষণায় বিবর্তন প্রক্রিয়ার সেসব বিষয় সম্পর্কে জানা যায়, যার পরিপ্রেক্ষিতে আজ আমরা এই মানুষ হয়ে উঠেছি।  

এনএফ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।