বাবা, আপনাকে অনেক ভালোবাসি
আমার বাবা সাজানো-গোছানো পরিপাটি একজন মানুষ। অপরদিকে আমি অগোছালো, অলস টাইপ। এলোমেলো থাকতেই আমার কাছে ভালো লাগে। বাবার এসব অবশ্য ভালো লাগে না। এ নিয়ে তো আর বাবার কম কথা শুনিনি। বাবা এসব নিয়ে কিছু বললে আমার রাগ হয়। বাবাকে বলি, ‘থাক না এসব। সময় হলেই গোছাবো।’
বাবা শুনতেন না, ‘এখনই গোছাতে হবে।’ মনে মনে রাগ হতো। ভাবতাম, বাবা আমাকে একটুও ভালোবাসেন না। সারাক্ষণ এসব নিয়ে শুধু রাগ, শান্তিতে থাকতে পারি না। মাঝে মাঝে প্রচণ্ড রাগে বাসার বাইরে যেতাম। কিছুক্ষণ পরে এসে দেখতাম, বাবা সব সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছেন, বিশেষ করে আমার পড়ার টেবিল, কম্পিউটার টেবিল আর বিছানা।
কিছুদিন আগের ঘটনা বলি। রোজার ঈদের আগে বাইক অ্যাক্সিডেন্ট করি। বিছানায় পড়ে ছিলাম বেশ কিছুদিন। পুরো বামহাত আহত হয়েছিল। ঠিকমতো শুতে পারতাম না। সারাক্ষণ ব্যথায় কাতর ছিলাম। সারারাত বাবা আমার পাশে ছিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। রাতে কখনো একটু চোখ বন্ধ হতো। চোখ খুলে দেখি বাবা তখনো আমার পাশে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আমাকে বলতেন, ‘আব্বু একটু ঘুমাও, ঘুমাও। আমি দাঁড়িয়ে আছি সমস্যা নেই।’ তখন আমি শুধু আব্বুর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কিছু বলতে পারতাম না।
হঠাৎ আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ল। ছোটবেলায় আমরা গ্রামে থাকতাম। তখন গ্রামে কোনো ডাক্তার ছিল না। মুকুল ডাক্তারই একমাত্র ভরসা। রাত প্রায় দুইটা। জ্বরে আমার শরীর পুড়ে যাচ্ছে। আব্বু ঢাকায় চাকরি করেন। আমার অসুখের কথা শুনেই বাবা ফোন দিয়েছেন ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার শুধু সময়ক্ষেপণ করছেন। বলছেন, ‘যাচ্ছি, যাচ্ছি’। কিন্তু আব্বু নাছোড়বান্দার মতো ফোন দিয়েই যাচ্ছেন। মুকুল ডাক্তারকে হুমকি দিয়ে বসলেন, ‘যদি আমার ছেলের কিছু হয়, আপনাকে আমি ছাড়বো না।’
প্রায় তিনটা কি তিনটার পর সঠিক মনে পড়ছে না, ডাক্তার এলেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘এ তো তেমন কোনো জ্বর নয়। হাল্কা জ্বর। পানি পট্টি দিলেই হতো। আমি সকালে এসেও দেখতে পারতাম।’ আম্মুর দিকে তাকিয়ে ডাক্তার বলছেন, ‘শান্তর বাবা যেভাবে বললেন আমাকে, যে অনেক অসুস্থ। এখনই যান, না হলে খবর আছে। আমি তো ভয়ই পেয়ে গেছিলাম। যা হোক, আসছি যখন আর কোনো সমস্যা নেই। ঠিক হয়ে যাবে।’ ডাক্তার ওষুধ দেওয়ার পর যখন চলে যাবেন; তখন আম্মু বললেন, ‘ভাই কিছু মনে করবেন না, ওর বাপ এমনই। ছেলের কিছু হয়েছে শুনলে মাথা ঠিক থাকে না।’ ডাক্তার কিছু না বলে নীরবে চলে গেলেন।
আমার বাবাকে কখনোই বুঝতে পারিনি। এখনো পারি না। সব সময় মনে হয়, আচ্ছা আমার বাবা এরকম কেন? সারাক্ষণ রাগ দেখান, আবার আমার কিছু হলে পাগলের মতো হয়ে যান। আমি লেখালেখি করি এটা বাবার নাকি পছন্দ নয়। আমাকে বলেন, ‘এগুলো লিখে কী লাভ? কিছুই হবে না।’
আবার গ্রামের বাড়িতে গেলে লোকজন ডেকে বলেন, ‘শুনলাম তুমি নাকি লেখালেখি করো? তোমার আব্বা তো চায়ের স্টলে খুব গর্ব নিয়ে বলে আমার ছেলে সাংবাদিক, সে লেখালেখি করে।’ আমি তাদের কথা শুনে কিছু বলি না। শুধু ‘জ্বি চাচা’ বলে সেখান থেকে চলে আসি। ভাবি, আমার বাবা আমার সাথে কেন এমন করেন? আমাকে বলেন এক আর অন্তরে আরেক।
বাবাও হয়তো ভাবেন, আমিও বাবাকে ভালোবাসি না। বাবা মনে করেন, ওকে শুধু বকি। এটা বলি সেটা বলি। ও হয়তো রাগ করে। এ লেখার মাধ্যমে বাবাকে বলতে চাই, ‘বাবা আপনি আমার অর্ধকলিজা, আমার জন্মদাতা। আপনার জন্য আমি এ পৃথিবীতে এসেছি। বাবা আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি, অনেক। আপনার রাগগুলো তাৎক্ষণিক বিরক্ত লাগলেও পরে বুঝতে পারি আপনি কেন বকেন। সব সময় আপনি আমাদের ভালো চান বিধায় এসব বলেন। আপনি দেখবেন, একদিন আপনার দোয়ায় আমি সফল হবো। আপনার মুখ উজ্জ্বল করবো। দোয়া করবেন সব সময় আমাদের জন্য।’
এসইউ/জিকেএস