বাবা একটি বটবৃক্ষের ছায়ার মতো
আজ থেকে প্রায় ১৪-১৫ বছর আগের কথা। তখন আমার বয়স ৮-৯ হবে। চাঁদপুর শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরেই আমাদের গ্রাম। এখানেই আমার শৈশব ও বেড়ে ওঠা। বলা যায়, ২০০০ সালের আগে জন্ম হওয়ায় আমাদের শৈশব বর্তমানের চেয়ে অনেক ভালো কেটেছে। আমি পরিবারের ছোট ছিলাম। সবার নজরের মধ্যেই থাকতে হতো। বাড়তি আদরের কমতি ছিল না।
বাবার হাত ধরেই আমার বেড়ে ওঠা। বাবার সঙ্গে গ্রামের হাট-বাজারে চষে বেড়িয়েছি। যেখানেই যেতেন আমাকে সাথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। বাবা তখন আমাকে খাতা-কলম, পোশাক, বল ও নানা ধরনের খেলনা কিনে দিতেন। যত শখ ছিল সাধ্যমত পূরণ করার চেষ্টা করতেন। কোনো কিছুর জন্য মন খারাপ হতে দেখলে সেটি দেওয়ার চেষ্টা করতেন।
শৈশবে কৃষিকাজ করলে বাবার সঙ্গে মাঠে চলে যেতাম। মইয়ের ওপরে উঠলে বাবা আমাকে টানতেন। ধানের চারা উঠানো, রোপণ করার চেষ্টা করা, ধান মাড়াই এসব শখের বশে বাবার সঙ্গে করা হতো। বাবা অন্যায়কে কখনো প্রশয় দেননি। হয়তো জেদের বশে কয়েকবার মেরেছিলেন। সব সময় শাসনের মধ্যে রাখতেন। আমার অসুখ বা কোনো কিছু হলে ঝাঁপিয়ে পড়তেন।
একদিন আমার অনেক জ্বর। বাবা কোনো একটি কাজে ঢাকায় গিয়েছিলেন। সব সময় জ্বর হলে বাবা অফিস থেকে এসেই আমাকে সুস্থ করার যুদ্ধে নেমে যেতেন। মাথায় পানি দেওয়া, ওষুধ খাওয়ানো, খাবার খাওয়ানো এসব বাবাই করতেন নিজে থেকে। কিন্তু সেবার আমি ভীষণ মিস করছিলাম। জ্বরের মধ্যে হয়তো তখন কয়েকবার বাবার নামও নিয়েছিলাম। এক-দুই দিন যাওয়ার পর বাবা আসেন না। এদিকে আমার জ্বর বাড়তেই থাকে।
সম্ভবত জ্বরের তৃতীয় দিন বাড়িতে এলেন। আমি তখন বিছানায় শুয়ে। বাবা ব্যাগ রেখে ও শার্ট খুলেই আমার কাছে এলেন। কপালে হাত দিলেন, জ্বরের তীব্রতা বুঝলেন। আমার জন্য ফল, জুস ও ওষুধ সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন। রীতিমতো আমাকে সেবা-যত্ন করতে থাকেন। বাবাকে দেখে আমার জ্বরের তীব্রতা কমতে শুরু করে। এখন ভাবছি, তখন জ্বরের চেয়ে বাবাকেই বেশি মিস করেছিলাম। এরকম অসংখ্য স্মৃতি। যা হয়তো কখনো বলে শেষ করা যাবে না।
বাবা সরকারি চাকরি করেন। খুবই ধার্মিক মানুষ। আমি বোঝার পর থেকে কখনো দেখিনি কোনো ওয়াক্তের নামাজ বাদ দিতে। তার কারো প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। কারো সাথে কখনো কটুকথা বলতে দেখিনি। সব সময় মানুষের ভালো ও মঙ্গল চিন্তা করেন। বাবার শৈশব কিছুটা কষ্টে কেটেছে। তখন অভাবের কারণে ক্লাস সেভেনে পড়াবস্থায় কর্মে নেমে পড়েন। তারপর থেকে আজ অবধি নিঃস্বার্থভাবে আত্মীয়-স্বজন ও আমাদের জন্য সব ত্যাগ করে যাচ্ছেন।
তার ত্যাগের কথা হয়তো কখনো বলে শেষ করা যাবে না। আমাদের ভালো থাকার জন্য সব সময় নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে থাকেন। কখনো আমাদের কোনো কিছুর অভাবে রাখেননি। যথাসাধ্য চেষ্টা করেন সব ইচ্ছা পূরণ করার জন্য। বাবা একটি পাঞ্জাবি বা শার্ট দিয়ে বছরের পর বছর পার করে দেন। কিন্তু আমাদের জন্য নতুন জামা-কাপড়ের ব্যবস্থা করে রাখেন। তিনি শুধু একটি কথাই বলেন, কোনো বাবাই চান না তার সন্তান খারাপ থাকুক। তেমনই আমিও চাই, আমার সন্তানরা সব সময় ভালো মানুষের মতো বাঁচুক এবং ভালো থাকুক।
আমি মনে করি, বছরের প্রতিটি দিনই বাবার গুরুত্ব সমান। নির্দিষ্ট দিনে বাবা দিবস পালন করার কিছু নেই। মানুষ যেমন অতিরিক্ত রোদের সময় গাছের নিচে ছায়া নেয়। তেমনই প্রতিটি সন্তানের কাছেই তার বাবা একটি বটবৃক্ষের ছায়ার মতো। দেখা যায়, অনেকে পছন্দ করে কোনো ফল গাছের বীজ রোপণ করেন। বীজ রোপণের পর একসময় চারাগাছে পরিণত হয়। নিয়মিত পরিচর্যার ফলে চারাগাছ থেকে আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠে। ডাল, পাতা গজানোর সাথে সাথে বড় হতে থাকে। একসময় সেই বেড়ে ওঠা গাছ ফল দেওয়া শুরু করে। প্রসঙ্গটি এ কারণে আনলাম যে, প্রতিটি বাবাই সন্তানের জন্ম থেকে শুরু করে বেড়ে ওঠার শেষ পর্যন্ত এভাবেই আগলে রাখেন।
সবশেষে বলতে চাই, সৃষ্টিকর্তার কাছে আমার একটাই চাওয়া, আমি যেন আমার বাবার সব শখ পূরণ করতে পারি। তার ভেতরের অজানা সব কষ্ট দূর করতে পারি। ‘ভালোবাসি বাবা’ কথাটি বুকে জড়িয়ে কখনো বলা হয়নি।
এসইউ/জিকেএস