মাধববাটীতে লিচু বিপ্লবের ইতিহাস
গ্রীষ্মের সবচেয়ে লোভনীয় ও স্বল্পমেয়াদী ফল লিচু। লিচুর জন্য দিনাজপুর জেলার বিশেষ সুনাম আছে। দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলার মাধববাটী গ্রামে লিচু চাষের গোড়াপত্তন করেন মৃত আলহাজ শামসুদ্দীন আহমেদ। তারই হাত ধরে বিরল উপজেলা এবং পরে দিনাজপুর জেলায় লিচু চাষের বিপ্লব ঘটেছে বলে জানা যায়।
শামসুদ্দীন আহমেদের ছোট ছেলে আফ্রাহিম বাদশা মানিকের সঙ্গে আমার সখ্য দীর্ঘদিনের। তিনি লিচু বাগান ঘুরতে যাওয়ার অনুরোধ করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। তবে আমার সময়-সুযোগ হয়ে ওঠেনি এতদিন। এবার লিচু বাগান ভ্রমণের সেই সুযোগ ধরা দিয়েছে।
দেশের সব ফলের বাজার এরই মধ্যে লিচুর রঙে রঙিন হতে শুরু করেছে। বাগানগুলোর গাছে গাছেও এখন থোকায় থোকায় পাকা লিচু। গাছ থেকে পেড়ে লিচু খাওয়ার ইচ্ছা এবং লিচু চাষের গোড়াপত্তন যে বাগান থেকে; সেই বিরল উপজেলার মাধববাটী গ্রামে যাওয়ার বাসনা থেকে ছুটে গেলাম গ্রীষ্মের তাপদাহ উপেক্ষা করে।
ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে রাতে আন্তঃনগর পঞ্চগড় এক্সপ্রেসে চড়ে ছুটে চললাম দিনাজপুর স্টেশনের দিকে।প্রায় দশ ঘণ্টা যাত্রা শেষে দিনাজপুর রেলওয়ে স্টেশন। সেখান থেকে অটোতে চড়ে বিরল উপজেলার মাধববাটী গ্রামে পৌঁছতে ঘড়ির কাটা সকাল ১০টা ছুঁইছুঁই করছে।
এ জেলার সব স্থানেই লিচু চাষ হয়। রেলওয়ে স্টেশন থেকে তিন-চার কিলোমিটার চলার পর সড়কের দুপাশে লিচুর গাছ চোখে পড়ে। মূল সড়ক ছেড়ে ছোট কোনো পার্শ্বসড়কে ঢুকে পড়লেই পাওয়া যায় পুরোনো গাছের বড় বড় লিচু বাগান। এ ছাড়া বিরল উপজেলায় দেখা যায়, বাড়িতে বাড়িতে লিচু গাছ এবং লিচু পাড়ার ব্যস্ততা। লিচুর বিভিন্ন জাতের মধ্যে মাদ্রাজি ও বোম্বাই জাতের লিচুর চাষ বেশি হয়ে থাকে।
আফ্রাহিম বাদশা মানিকের সঙ্গে তার লিচুর বাগানে ঢুকতেই চোখে পড়লো লিচু পাড়ার কর্মযজ্ঞ। নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা চুক্তিভিত্তিক লিচু পেড়ে থাকে। গ্রামের বিভিন্ন বয়সী মানুষের অংশগ্রহণ রয়েছে এ কাজে। অনেকটা উৎসবমুখর পরিবেশে তারা কাজটি করে থাকেন। সরাসরি বাগান থেকে পাইকারি ক্রেতারা লিচু সংগ্রহ করে তা দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠিয়ে থাকেন।
রসালো লিচু গাছ থেকে নিজ হাতে পেড়ে খাওয়ার মজাই একটু আলাদা। লিচু খেতে খেতে কথা হলো বাগানের মালিক আফ্রাহিম বাদশা মানিকের সঙ্গে। তিনি জানালেন, তার বাবা আলহাজ শামসুদ্দীন আহমেদ যখন লিচু চাষ শুরু করেন; তখন অনেকে বিষয়টিকে উদ্ভট আচরণ হিসেবে দেখেছেন। কেননা ধানের জমিতে লিচু চারা রোপণ বিষয়টি স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে নিতে পারেননি এলাকার মানুষ।
তবে তার বাবার লিচু চাষের সফলতা একসময় অন্যদের উদ্বুদ্ধ করেছে। তিনি বিরল উপজেলাসহ দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলায় পরামর্শ এবং লিচু চারা দিয়ে মানুষকে সহযোগিতা এবং উদ্বুদ্ধ করেন। স্থানীয় জনগণের সঙ্গে আলাপকালেও তার বাবার লিচু বিপ্লবের বিষয়টি ফুটে ওঠে।
দিনাজপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দিনাজপুর জেলায় ৫ হাজার ৪৮১ হেক্টর জমিতে লিচু বাগান রয়েছে সাড়ে ৫ হাজার ৪১৮টি। এর মধ্যে বোম্বাই লিচু ৩ হাজার ১৭০ হেক্টর জমিতে, মাদ্রাজি ১ হাজার ১৬৬ হেক্টর, চায়না থ্রি ৭০২ দশমিক ৫ হেক্টর, বেদানা ২৯৪ দশমিক ৫ হেক্টর, কাঁঠালি ২১ হেক্টর এবং মোজাফফরপুরী লিচু ১ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে। বসতবাড়ির উঠানসহ বাগানগুলোয় লিচু গাছ আছে সাত লক্ষাধিক। যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
আফ্রাহিম বাদশা মানিকের সঙ্গে আলাপে উঠে আসে লিচুচাষিদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। লিচু চাষে আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় প্রয়োজন। একইসঙ্গে সরকার হিমাগার তৈরি করলে লিচু সংরক্ষণে চাষিদের সুবিধা হয়। লিচুচাষিদের সহজ শর্তে লোনের ব্যবস্থার পাশাপাশি এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হলে কৃষকদের অর্থনৈতিক সংকট যেমন কমে আসবে, একইসঙ্গে সহজ হবে লিচু বাজারজাতকরণ।
লিচুর বাগানে মধ্যদুপুরে সূর্যের উত্তাপ যেমন আছে, একইসঙ্গে আছে শতাধিক শ্রমিকের লিচু সংগ্রহের কর্মব্যস্ততা। তাদের সাথে লিচু সংগ্রহ এবং লিচুর রসালো স্বাদ উপভোগ করতে করতে সময় কেটে অপরাহ্ন। দিনব্যাপী লিচু বাগানের কর্মব্যস্ততা এবং লিচুর স্বাদ গ্রহণে নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চার হলো লিচুর রাজ্য দিনাজপুরের মাধববাটীতে।
এসইউ/জিকেএস