নকশিকাঁথায় গাঁথা পড়ছে নারীর কষ্ট
উত্তরবঙ্গের জেলা ঠাকুরগাঁওয়ের নারীরা অভাব জয়ের তাগিদে কর্মমূখী হয়ে উঠলেও প্রাপ্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সীমান্ত সংলগ্ন এ জেলায় দৈনিক হাজিরা বা মজুরি কম হওয়ার সুবাদে ঢাকার কিছু কারুপণ্য বিক্রির প্রতিষ্ঠান ঠাকুরগাঁওয়ের স্থানীয় এনজিওগুলোর (বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা) মাধ্যমে গ্রাম-গঞ্জের নারীদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে নকশিকাঁথা তৈরিতে নিয়োজিত করে। এর ফলে এই এলাকার অনেক অভাবী পরিবার স্বচ্ছল হতে শুরু করে।
অথচ এক সময় এ অঞ্চলের নারীরা বাড়িতে অলস সময় কাটাতেন। কিছুদিন ধরে তারা এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। তৈরি করছেন মন মাতানো রং-বেরঙের যতসব নকশিকাঁথা। তাদের তৈরি এসব নকশিকাঁথা এখন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে। সেই সঙ্গে কেড়েছে সুনামও।
সরেজমিনে সদর উপজেলার রহিমানপুর, শিবগঞ্জ, মাদারগঞ্জসহ আরো কয়েকটি নকশিকাঁথা তৈরির গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, নারীরা সারিবদ্ধভাবে নকশিকাঁথা তৈরিতে ব্যস্ত। তেমনি এক গ্রাম হলো ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রহিমানপুর। বেশ কিছুদিন আগেও এ গ্রামের নারীরা স্বামীর আয়ের দিকে চেয়ে থেকে দিন পার করতেন। তারাই এখন বাড়ির উঠানে, বাঁশবাগানে চার-পাঁচজনের দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন নকশার কাঁথা তৈরি করছেন।
সুই-সুতার ফোঁড় দিয়ে নিপুণ হাতে তৈরি করা তাদের নকশিকাঁথাগুলো হলো, সুজনী কাঁথা, কার্পেট কাঁথা, লেশকাঁথা, স্যাঁথা, বনমালী, কল্যাফুল, জমিনফুল, বকুলফুল, চেইনফোঁড়, তয়লাকাঁথা, ভরাইসোজা, বেডজমিন, দড়িজমিন, ট্যালকাঁথা, ছন্দকাঁথা, ঘাটসেলাই, ডালালিক, পানতাসফুল, লিকলোহিরা, শিষ ফুল, জাহাজ ফুল, আয়না কাটা, বিস্কুট ফুল, বুতাম ফুল, লিক টানা, সোজা লিক, তিন ফোঁড় ও ভাঙা কাঁথা। একটি নকশিকাঁথা তৈরি করতে এক-দুই মাস সময় লাগছে তাদের।
বামুনিয়া গ্রামের গৃহিণী সেতারা বেগম জাগোনিউজকে বলেন, বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে স্বামীর আয়-রোজগারের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম, কিন্তু এখন নকশিকাঁথা তৈরি করে প্রতি মাসে ২ হাজার থেকে ২২০০ টাকা আয় করে সংসার ভালোভাবে চালাতে পারছি। ফলে স্বামী আগের চেয়ে এখন যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। একই গ্রামের গৃহবধূ শারমিন আক্তার বলেন, আমরা নিজেরা নকশিকাঁথা তৈরি করি এবং কেউ অর্ডার দিলে চুক্তি মোতাবেক সেলাই করে থাকি।
রহিমানপুর উচ্চবিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণির ছাত্রী শিউলী জানান, তার বাবা গরিব হওয়ায় পড়ালেখার খরচ ঠিকমতো বহন করতে পারে না। তাই শিউলী পড়ালেখার পাশাপাশি নকশিকাঁথা তৈরি করে পড়ালেখার খরচ চালায়।
নকশিকাঁথা তৈরির শুরুর দিকের সুসংবাদ এখনো যেনো স্থির হয়ে আছে এসব গ্রামে। নতুন করে দীর্ঘদিনেও কোনো সুসংবাদ পাচ্ছেনা এসব গ্রামের নারীরা। প্রতিদিনি নকশিকাঁথায় গাঁথা পড়ছে তাদের কষ্টগুলো। তাই এক সময়ের আশীর্বাদ এখন কষ্টে রুপ নিয়েছে। নারীরা নকশিকাঁথা তৈরি করে প্রথমের দিকে পরিবারকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করলেও এখন আর পারছেন না। এর কারণ হলো প্রাপ্য মজুরি কমিয়ে দেওয়া। কাজ শেষে সঠিকভাবে টাকা না প্রদান করা। শুধু তাই নয়, তাদের প্রাপ্য টাকাও বকেয়া রাখা হচ্ছে এবং টাকা প্রদানে ঝামেলা করছে মালিক পক্ষ। ফলে নকশিকাঁথা তৈরিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন এসব নারী।
গৃহবধূ শারমিন বেগম অভিযোগ করে বলেন, মালিকরা আগের চেয়ে এখন অনেক কম টাকা দিচ্ছে আমাদের। বেশির ভাগ সময় টাকা বাকি রাখা হচ্ছে। টাকা দিতে চায় না। এলাকার অনেক নারীর টাকা বকেয়া রয়েছে। এভাবে করলে একদিন কাঁথা তৈরি করা বন্ধ করে দিবে নারীরা। তিনি আরও বলেন, সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এবং স্থানীয় বাজার তৈরি হলে আমরা ন্যায্যমূল্য পাব। এতে নকশিকাঁথার কদর আরো বাড়বে।