বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক সুতোয় গাঁথা

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২:৪৮ পিএম, ১৭ মার্চ ২০২২

মো. হাবিবুর রহমান

স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় অতিক্রম করেছে। এ দেশটির আর্থ-সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি সাধিত হয়েছে। তথাপিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঝড়ো হাওয়া বইছে, সে সকল সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে আরও অনেক দূর পাড়ি দিয়ে সামনে এগোতে হবে।

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান এ দেশের জন্য অসামান্য। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির নামের সঙ্গেও অতপ্রোতভাবে জড়িত। সময়ের পরিক্রমায় তিনি এশিয়া ও বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে একজন কিংবদন্তী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।

তিনি ১৯২০ সালে গোপালগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বি.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়াও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে অধ্যয়ন করেন।

১ম ও ২য় মহাযুদ্ধের পর ভৌগলিকভাবে ও কৌশলগত অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এ সকল পরিবর্তনের মাধ্যমে কোনো রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে হয়েছে ভিন্ন অবস্থা। কেউ বা নিজেকে মানচিত্রের আল্পনায় নিজেকে স্থান করে নিতে পেরেছে। আবার কেউ বা মহাকালের অতল গহবরে হারিয়ে গেছে।

রাষ্ট্রের এ সকল ভৌগলিক সীমারেখার কারণে সমাজ জীবনে এসেছে নানা পরিবর্তন ও বসন্তের আগমন। বাঙালি জাতির জীবনে মার্চ মাসকে ফাগুনের সঙ্গে তুলনা করা যায়। পুরাতনকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ছিল জাতির সামনে। সে সময় পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও বঞ্চণার কারণে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বিভিন্ন মিশ্র অনুভূতি ও সংকটের জন্ম দিয়েছিল।

যেমন বসন্তের পর কালবৈশাখী ঝড় শুরু হয়। তেমনি জাতির জীবনে কালবৈশাখীর থাবা এসে পড়েছিল। জাতি সে সকল সংকট উত্তোরণ করেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে মিলিত হয়ে ঐতিহাসিক ৭ ই মার্চের ভাষণ দিয়ে জাতিকে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। ফলে বাঙালি জাতির জীবনে বসন্ত রক্তজবা হয়ে ধরা দেয়।

সেখানে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপরেখা ঘোষণা করলেন এবং করণীয় কর্মক্ষেত্রগুলো নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। এ অগ্নিঝরা মার্চ মাসের আবহ ও ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে সহায়তা করেছে। পরবর্তীতে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনে। বঙ্গবন্ধুর এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে ছাত্রত্ব হারিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু ছাত্রাবস্থায় থেকে রাজনীতি ও মানুষের অধিকার আদায়ে সচেতন ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিতে নতুন উদ্যমতা শুরু হয় এবং তার হাতেই ছাত্রলীগের জন্ম হয়। তৎকালীন ছাত্র সম্প্রদায়কে নিয়ে ১৯৪৮ সালে ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্বের মধ্যে একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস অনন্য হয়ে আছে। একটি জাতি রাষ্ট্র গঠন ও জাতির আত্মসচেতনা জাগ্রতকরণে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অপরিসীম।

বাঙালি জাতির জীবনে এক মহিয়সী নারী বঙ্গবন্ধুকে মানসিকভাবে ও সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেছিলেন তিনি আমাদের নিকট বঙ্গমাতা ফলিজতুন্নেসা মুজিব নামে সমধিক পরিচিত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরবর্তীতে ফলিজতুন্নেসা রেণুকে বিবাহ করেন।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থের নারী কবিতায় লিখেছেন, “কোনো কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারী, প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষী নারী। রাজা করিতেছে রাজ্য-শাসন, রাজারে শাসিছে রাণী, রাণীর দরদে ধুইয়া গিয়াছে রাজ্যের যতগ্লানি। বিজয়লক্ষী নারী হিসেবে শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের পাশে ছিলেন। তাদের ২ মেয়ে এবং ৩ ছেলে। বঙ্গবন্ধু পরিবার বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক অবিস্মরণীয় নাম। রাজনৈতিক মঞ্চে তার আগমনের কারণে রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও ইতিহাসে ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন মূলত বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব দিয়ে জাতিকে সামনে এগিয়ে নিয়েছেন। ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক পদে আসীন ছিলেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় কৃষি, সমবায়, পল্লী উন্নয়ন বিভাগে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দীর্ঘ নয় মাসের বেশি সময় পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বিহীন যে শূন্যতা ছিল তা পূরণ হয়। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও উদ্যোগ গ্রহণ করেন। একটি আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের জন্যে তিনি যে সকল উদ্যোগ গ্রহণ করেন তার অন্যতম হলো যথাক্রমে সংবিধান প্রণয়ন, ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমে গতি সঞ্চার, মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অস্ত্রসমর্পনের নির্দেশ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পুনর্গঠন, প্রথম সাধারণ নির্বাচন আয়োজন, প্রত্যেকটি মহকুমাকে জেলায় রূপান্তর, শিক্ষা কমিশন গঠন, পরিকল্পনা কমিশন গঠন, ১ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন, ব্যাংক জাতীয়করণ, মুুুদ্রা ও টাকা চালুকরণ, কৃষি সংস্কার, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নতি সাধন ইত্যাদি।

এছাড়াও বঙ্গবন্ধু পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে প্রভূত কল্যাণ সাধন করেন। তার শাসনামলে ১২৭টি দেশ কর্তৃক স্বাধীনতার স্বীকৃতি আদায় করতে বাংলাদেশ সমর্থ হয়। অন্যদিকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার তার শাসনামলের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম সাফল্য।

১৯৭৫ সালে একদল বিপথগামী সৈন্য ও কতিপয় গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের শিকার হন বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকেসহ তার পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশের রাজনীতি এক ধরনের অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। তা থেকে উত্তরণ পেতে জাতিকে দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করতে হয়েছে। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাংলাদেশের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ ও তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যে তিনি নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের সাথে অনেক কিংবদন্তী, গুণীজন ও মহীয়সি নারী, লেখক, কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক, ডাক্তার, সাংবাদিক, ও বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম জড়িত। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির জন্য পাঞ্জেরির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তার কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্নপ্রকাশ করেছে।

রংপুর অঞ্চলে যে সকল গুণীজন স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রেখেছেন ও বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়েছেন তাদের অন্যতম হলো বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ও রংপুরের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ খোন্দকার মুখতার ইলাহী। এ সকল ব্যক্তিসহ অন্যান্য মুক্তিকামী মানুষের নামও এ অঞ্চলের স্বাধীনতার ইতিহাসের সাথে জড়িত।

বর্তমান তরুণ প্রজন্ম বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে হলে তা লিখিত তিনটি বই অধ্যয়ন করতে হবে। তাহলে এর মাধ্যমে তারা বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে পারবে। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের সমৃদ্ধি অর্জন করতে আমাদের মধ্যে পারস্পারিক আন্তরিকতা ও সৌহার্দপূর্ণ আচরণের বহিঃপ্রকাশের উপর গুরুত্বারোপ করতে হবে।

ঋতুরাজ বসন্তের যে গতি ও আবেগ রয়েছে তা আবার বাঙালি জাতির জীবনে ছড়িয়ে পড়ুক। বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন ও লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশকে দেখতে চেয়েছিলেন তা প্রতিষ্ঠার জন্যে নিরন্তর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। চারদিকে যে অস্থিরতা ও অসামঞ্জস্যতা রয়েছে তা কাটিয়ে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কমিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট মহলকে আরও সোচ্চার হতে হবে। এটাই হোক বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের অন্যতম প্রত্যয়।

লেখক: কলামিস্ট, কবি

কেএসকে/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।