উত্তরাঞ্চলে আবারও সংগঠিত হচ্ছে জেএমবি
গোয়েন্দা পুলিশ মনে করছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি দল জেএমবি উত্তরাঞ্চলে পুনরায় সংগঠিত হয়েছে। কারণ নিজেদের অস্তিত্ব স্বীকার করে জেএমবিই দেশের বিভিন্নস্থানে হামলা করছে। আর যেহেতু উত্তরাঞ্চল বিচরণ ক্ষেত্রের জন্য সেরা, এ কারণে যতো রকম সাজসজ্জা ও প্রশিক্ষণ তা চলছে এখানকার বিভিন্ন দুর্গম এলাকা ঘিরে। সদস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রেও তারা এই অঞ্চলকে গুরুত্ব দেয় বেশি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলে তৎপর হয়ে ওঠা জঙ্গি সংগঠনের শতাধিক আত্মঘাতী নারী-পুরুষ পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি ও গ্রেফতার এড়াতে সাধারণ মানুষের দলে মিশে গেছে। গোয়েন্দারাও এই তথ্যের সত্যতা স্বীকার করেছে। বয়সে তরুণ হওয়ায় এদের শনাক্ত করা গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষে দূরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেখা গেছে, এর আগে গাজীপুরে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গি সদস্যদের অধিকাংশের বাড়ি এই উত্তরাঞ্চলে। হোসনি দালান ও দারুস সালাম থানা পুলিশের উপর হামলাকারীরাও এই অঞ্চলের। সর্বশেষ মসজিদের হামলার ঘটনার পর উত্তরাঞ্চলের বগুড়া, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, নীলফামারী, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাগঞ্জ জেলায় অভিযান চালানো হয়েছে। তবে এখনো কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসেনি। তবে পুলিশের ধারণা ছিল এই সংগঠনটি দুর্বল হয়ে গেছে। কিন্তু সম্প্রতি জেএমবির পুনর্জাগরণের বিষয়টি তারা অনেকটাই নিশ্চিত।
পুলিশের রেকর্ড থেকে জানা গেছে, গাজীপুর পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে গ্রেনেড বিস্ফোরণের পর গ্রেফতার হওয়া জেএমবি সদস্য নাসরিন আক্তার, মাসুদ রানা, আতিকুর রহমান ও জাহিদ হাসান উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দা। তাদের মধ্যে মাসুদ রানা গাইবান্ধা সদরের কুপতলা গ্রামের ফরহাদ আলী প্রমাণিকের ছেলে, আতিকুর রহমান একই জেলা সদরের পর্বকোমড়নই গুদারাঘাট গ্রামের সাইদ মিয়ার ছেলে, জাহিদ হাসান বগুড়া জেলার শেরপুরের বানিয়াগাতি গ্রামের আলী আকন্দের ছেলে ও নাসরিন আক্তার দিনাজপুরের চিরিরবন্দরের বাসুদেবপুর গ্রামের বাসিন্দা। এর আগে গ্রেফতারকৃত মামুনুর রশীদ মামুনও গাইবান্ধার সাঘাটার বারোকোনা মধ্যপাড়া এলাকার ফয়েজার রহমান মাস্টারের ছেলে।
জেএমবির পেছনের ইতিহাস থেকে জানা গেছে, পুরো বিশ্বের কাছে জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ বা জেএমবি তাদের অস্তিত্ব জানান দিয়েছিল অনেকটা নাটকীয়ভাবে। ২০০৫ সালের ১৭ অাগস্ট সারাদেশে একযোগে বোমা ফাটিয়ে তাদের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। বেশ কিছু সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটার পর এটিকে নিষিদ্ধ করা হয়। আর ফাঁসি দেয়া হয় সংগঠনের প্রধান শায়েখ আবদুর রহমান ও বহুল আলোচিত সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাইসহ ছয়জনকে।
এরপর পুলিশের পক্ষ থেকে অনেকবারই বলা হয়েছিল, জেএমবি দুর্বল হয়ে গেছে এবং এটি আর মাথা তুলতে পারবে না। কিন্তু দশ বছর পর জেএমবি নিয়েই আবার ব্যতিব্যস্ত পুলিশ। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেশ কিছু লোকের অর্থ সহায়তায় এই সংগঠনটি চলছে। উত্তরাঞ্চল ছাড়াও দেশের কয়েক জায়গায় তাদের ক্যাডার রয়েছে। এদের একজন নিহত হলেও আরেক ব্যক্তি দায়িত্ব নেয়।
পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা মনসুর আলী বলছেন, জেএমবির পুনর্জাগরণের প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায় গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে, যখন মহাসড়কে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে তিনজন শীর্ষস্থানীয় জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়া হয়। অপরাধবিষয়ক গবেষক নূর খান লিটন বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে অনেকবার বলা হয়েছে যে জঙ্গি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নেয়া হয়েছে। তাহলে জেএমবির মতো একটি সংগঠন আবারও পুনর্গঠিত হলো কীভাবে?
বগুড়ার পুলিশ ও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, এখন নতুন করে আবারো উত্তরাঞ্চলে পাঁচ শতাধিক জঙ্গি সদস্য রয়েছে। এর মধ্যে প্রশিক্ষিত শতাধিক নারী আত্মঘাতী সদস্যও রয়েছে। এদিকে বগুড়া ডিবি পুলিশ ৩০ জনের তালিকা নিয়ে ইতোমধ্যেই বিভিন্নস্থানে অভিযান চালিয়েছে। তবে কাঙ্খিত সাফল্য পায়নি।
একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাও এ পর্যন্ত আটকদের তথ্যমতে পুলিশ জানিয়েছে, উত্তরাঞ্চলের মধ্যে বগুড়ায় রয়েছে তাদের অন্যকম ঘাঁটি। দুর্গম গ্রামসহ চরাঞ্চলে অবস্থান নিয়ে সংগঠনের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রশিক্ষণ দিচ্ছে আত্মঘাতী নারী ও পুরুষ সদস্যদের। জেএমবির সেকেন্ড ইন্ড কমান্ড সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইয়ের বগুড়ায় বাড়ি হওয়ার সুবাদে সংগঠনের আঞ্চলিক ভিত্তি গড়ে ওঠে। তারপর পার্শ্ববর্তী জামালপুরে জেএমবির প্রধান শায়খ আবদুর রহমানের বাড়ি হওয়ায় যোগাযোগের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকে তারা। সঙ্গে যোগ হয় গাইবান্ধার সাঘাটা। এই সাঘাটায় সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি হওয়ায় এই এলাকার অনেকেই জেএমবির সদস্য হয়ে যায়।
এর আগে বগুড়া পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া জেএমবির সেকেন্ড ইন কমান্ড ভাগ্নে শহীদ পুলিশকে জানিয়েছিল, উত্তরাঞ্চলের মানুষ সহজ সরল। ধর্মীয় মতভেদের কথা বললে তারা সদস্য হতে রাজি হয়ে যায়। আর এদের চাহিদাও অনেক কম। এ কারণে আগে থেকেই জেএমবির উৎপত্তি ছিল উত্তরাঞ্চলে।
জেএমবির আরো এক র্শীষ নেতা হলেন শায়খ আবদুুর রহমানের অন্যতম সহযোগী ফুফা আবদুর রহিম। শায়খ আবদুুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার আগে বগুড়ার আল আরাফাহ ব্যাংকে জেএমবির প্রধান শায়খ আবদুুর রহমান ও আবদুুল আউয়ালের জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট পাওয়া গিয়েছিল। আব্দুল আউয়াল গ্রেফতারের আগে বগুড়া শহরের ঠনঠনিয়ায় বাসা ভাড়া নিয়ে পরিবারসহ বসবাস করতেন এবং জেএমবির কার্যক্রম চালিয়ে যেতেন।
জঙ্গি হামলার শঙ্কায় আট জেলায় বিশেষ সতর্কতা নিয়েছে পুলিশ। সম্প্রতি মসজিদে হামলার ঘটনার পর এই সতর্কতা নেয়া হয়। বগুড়ার পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান জানান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষতে নাশকতা সৃষ্টিকারী এবং সন্দেহভাজনদের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান শুরু করা হয়েছে। একই রকমের তথ্য দিয়ে নওগাঁর পুলিশ মোজাম্মেল হক জানান, নির্দেশনার পরপরই সর্বত্র পুলিশি নজরদারি এবং জঙ্গি গ্রেফতার অভিযান বাড়ানো হয়েছে।
বগুড়া পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, বগুড়াসহ চারটি জেলায় একযোগে সশস্ত্র হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছিল নতুন জঙ্গিদল বিইএম। জেএমবির দেশব্যাপি চালানো সিরিজ বোমা হামলার মতোই হতো এই হামলাটিও। তবে এবারের টার্গেট ছিল থানা ও পুলিশ ফাঁড়িগুলো। পরিকল্পনা অনুযায়ী অস্ত্র লুটের পর তারা পর্যায়ক্রমে পুলিশের ওপরও হামলা চালাতো। এরপর ২০১৩ সালের আগস্টে বগুড়া শহরের একটি আবাসিক এলাকার জঙ্গি আস্তানা থেকে গ্রেফতার হওয়া তিন জঙ্গির বক্তব্য এবং তাদের কাছে থাকা কাগজপত্র পর্যালোচনা করে গোয়েন্দারা এসব তথ্য উদ্ধার করেছেন।
ওই পুলিশ কর্মকর্তা আরো জানান, জঙ্গিরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গেছে। তারা যেসব সদস্য দলে নিচ্ছে তাদের বয়স ১৯ থেকে ২৩ বছরের মধ্যে। এদের নিয়ে শহরের ব্যস্ততম এলাকায় ছাত্রাবাস তৈরির কথা বলে বাড়ি ভাড়া নেয়া হচ্ছে। এরপর সেখানে চলে মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী জঙ্গি প্রশিক্ষণ।
পুলিশের কর্তরা জানান, প্রথমদিকে জেএমবির আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশের আগে প্রথম ভয়াবহ জঙ্গি হামলা জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলাল থানার উত্তর মহেষপুর গ্রামে। ২০০৩ সালের ১৪ আগস্ট সেই জঙ্গি হামলায় পুলিশের সঙ্গে বন্ধুকযুদ্ধে ওসিসহ তিন পুলিশকে জখম করে পুলিশের তিনটি শর্টগান ও একটি ওয়াকিটকি ছিনিয়ে নিয়েছিল জঙ্গিরা। ওই ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছিল ২২ জন। অথচ, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারাদেশে সিরিজ বোমা হামলাসহ অন্যান্য বোমা হামলা এবং জঙ্গি তৎপরতায় শীর্ষ ছয় জঙ্গি নেতা শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, আব্দুল আওয়াল, আতাউর রহমান সানী, মামুন ও খালেদ সাইফুল্লাহর ফাঁসি কার্যকর হলেও প্রথম জঙ্গি হামলা এবং অস্ত্র লুটের মামলাটি কাঙ্খিত সাফল্য আসেনি।
এর আগেও ২০০৫ সালে বগুড়া ডিবি পুলিশ ইসলামী জঙ্গি সংগঠন জামাআ’তুল মুজাহিদীনের মহিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সন্ধান পায়। বগুড়া শহরের উপকণ্ঠে আকাশতারায় মহিলা মাদ্রাসার আড়ালে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়ার নামে রাতের আধারে জঙ্গি সংগঠনের প্রশিক্ষণ চলতো। তাছাড়া মহিলা ক্যাডারদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি পুরুষ সদস্যরাও এই মাদ্রাসাকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতো। চাঁদে সাইদীকে দেখার গুজব ছড়িয়ে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্নস্থানে যে হামলা চালানো হয় সেটির ভয়াবহতাও ছিলো বগুড়ায় বেশি। বগুড়াকে তারা বিভিন্ন কারণে এখন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করছে গোয়েন্দা সে ব্যাপারে নিশ্চিত। তবে তারা জানায়, বহুমুখী ছদ্মবেশে এখন সক্রিয় জেএমবি সদস্যরা। বাসা বাড়িতে দারোয়ান, ক্ষেত মজুর আবার মাছ ধরা এরকম বহুমুখী ছদ্মবেশে তারা জেএমবির কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
বগুড়ায় পুলিশি নজরদারিতে একাধিক মাদ্রাসা : নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামী জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীনের সদস্যসহ ইসলামী জঙ্গি ক্যাডারদের ধরতে বগুড়া পুলিশ বিশেষ অভিযান শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই এই অঞ্চলের অর্ধশতাধিক জঙ্গি সদস্যের তালিকা তৈরি করেছে পুলিশ। জঙ্গিদের আনাগোনা আছে এবং তাদের প্রশিক্ষণ হয় এমন কিছু সন্দেহভাজন মাদ্রাসার তালিকাও করেছে পুলিশ। এসব মাদ্রাসার উপর সাদা পোশাকধারী পুলিশের নজরদারি রয়েছে।
বগুড়ার বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে অর্ধশতাধিক মাদ্রাসা। অধিকাংশ মাদ্রাসার শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে স্থানীয় প্রশাসন অবগত নয়। শহরের অভ্যন্তরে এমন অনেক মাদ্রাসা রয়েছে যেগুলো সুউচ্চ প্রাচীর দিয়ে পরিবেষ্টিত। বাইরের মানুষ ইচ্ছে করলেই যখন-তখন এসব মাদ্রাসায় ঢুকতে পারবে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একজন পদস্থ কর্মকর্তা জানান, তারা সন্দেহ করছেন এসব মাদ্রাসায় শিক্ষা ব্যবস্থার অন্তরালে জঙ্গি প্রশিক্ষণ হতে পারে।
এমএএস/বিএ