শহীদ মিনারের স্থপতি আমার বাবা

নওশাবা খুদা
বিগত ৩ দশক ধরে মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে আছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা ভাষার জন্য শহীদ হয়েছিলেন অনেকেই। দীর্ঘ ৫ বছর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানোর পর অবশেষে ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদদের তাজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলা ভাষা।
বাংলাকে তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার পর ১৯৫৭ সালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। মূল শহীদ মিনারের নকশা করেন স্থপতি হামিদুর রহমান। ১৯৫৬ সালের শরৎকালে হামিদুর রহমান আর্ট বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি সম্পন্ন করে ইংল্যান্ড থেকে দেশে ফিরে আসেন।
প্রয়াত শিল্পী জয়নুল আবেদীন এবং তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী এম এ জব্বারের সঙ্গে হামিদুর রহমানের যোগাযোগ হয়। তাদের অনুরোধেই আমার বাবা স্মৃতি প্রকল্পের ধারণা সম্পর্কিত একটি মডেল, চিত্র এবং কাগজপত্র জমা দিয়েছিলেন। শহীদ মিনারের জন্য বাবার নকশাটি বেছে নেওয়া হয়।
শহীদ মিনারের প্রথম ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের মাঠে ১৯৫৭ সালের নভেম্বরে। যদিও সরকার কাজটির সময় বেঁধে দিয়েছিলেন ১৯৫৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। তবে নির্দিষ্ট সময় আসার আগেই প্রকল্পের কাজ বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। সবে তখন শহীদ মিনারের অবয়বটুকু সম্পন্ন হয়েছিল।
আমার বাবা মিনারের বেসমেন্টে ১ হাজার বর্গফুট জুড়ে ভাষা আন্দোলনের ম্যুরাল চিত্রকর্মটি শেষ করেছিলেন মাত্র। এরপর ১৯৫৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি অসম্পূর্ণ এ শহীদ মিনারের সামনেই ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। এর কিছুদিনের মধ্যেই সামরিক আইন কার্যকর হয়। তখন শহীদ মিনার একটি রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়।
এর ৫ বছরেরও বেশি সময় পর ১৯৬৩-৬৪ সালে কিছুটা আশার আলো জ্বলে ওঠে। এর মাঝেও আমার বাবা শহীদ মিনার পুনর্গঠনের জন্য বহুবার চেষ্টা করেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এটি সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের উত্থানের পরপরই সরকার মিনারটি পুনর্গঠনের ঘোষণা দেন।
১৯৭২ সালে নতুন এক প্রতিযোগিতায় বাবার আঁকানো নকশা দ্বিতীয়বারের জন্য নির্বাচিত হয়। শহীদ মিনারের কেন্দ্রীয় নকশা তৈরি করেছিলেন বাংলাদেশি ম্যুরালিস্ট এবং শিল্পী হামিদুর রহমান। বাংলাদেশের ১ম ও ২য় শহীদ মিনারের স্থপতি আমার বাবা।
আমার বাবা হামিদুর রহমান ছিলেন এক অসাধারণ মানুষ। তিনি সময়ের কিংবদন্তি। তিনি বেঁচে থাকাকালীন যেমন অনেক খ্যাতি পেয়েছিলেন এবং মৃত্যুর পরেও তিনি সম্মানিত ও শ্রদ্ধার মানুষ।
তার কাজ ও ভালোবাসা কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। কবিতায় নিজের অভিব্যক্তির বিকাশ ও প্রকাশের সৌভাগ্য হয়েছিল। আমার বাবা ৩২ বছর আগে ১৯৮৮ সালে মারা গেলেন। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, ‘সময় নয় বরং মৃত্যু সবকিছুই পরিবর্তন করে দেয়। সময় কেবল নিজেকে পুনরায় জীবিত করতে সুযোগ দেয়।’
আমি এখনো বাবার গলার স্বর ও তার গল্পগুলো মিস করি। বাবার সঙ্গে দাঁড়িয়ে তার উষ্ণতা আর অনুভব করতে পারি না। হঠাৎ কীভাবে জীবন বদলে গেল? গভীর বেদনা মনেই রয়ে গেছে। তবে এখন উপলব্ধি করি, বাবা যেন আমার আত্মার সঙ্গে মিশে আছেন।
আমার বাবা হামিদুর রহমানের তৈলচিত্রকর্ম, কবিতা ও সংগীতের নতুন প্রকাশনা পেতে দয়াকরে অ্যামাজন ও বার্নস অ্যান্ড নোবেলগুলো দেখুন।
লেখক: শহীদ মিনারের স্থপতি হামিদুর রহমানের মেয়ে।
জেএমএস/এসইউ/এমকেএইচ