মানুষের জন্য কিছু করার সময় এখনই

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩:১১ পিএম, ৩০ জুন ২০২০

ভাস্কর ভাদুরী বর্তমানে যমুনা টিভিতে সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কাজ করছেন। এর আগে ছিলেন একাত্তর টিভিতে। সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন দুর্যোগ এবং দুর্ঘটনা সরাসরি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে তার। করোনাভাইরাস বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহের কাজ করছেন খুব কাছ থেকে।উর্মিলা সরকার-কে জানিয়েছেন তার সেই অভিজ্ঞতার গল্প। 

করোনাসংশ্লিষ্ট খবর সংগ্রহের দায়িত্ব পেয়ে আপনার অনুভূতি কেমন ছিল?

- করোনা মহামারির শুরুর দিকে আমি বাসায় বসে বিভিন্ন ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহার করে রিপোর্টিংয়ের কাজ শুরু করি। কিন্তু কিছু দিন না যেতেই উপলব্ধি করলাম, এভাবে ঘরে বসে রিপোর্ট করলে মানুষের দুঃখ-কষ্টের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা যাবে না। ঠিক সেই সময়ই আমার সুপারভাইজার মহসিন-উল হাকিম আমাকে করোনাসংশ্লিষ্ট কিছু গল্প সংগ্রহ করার দায়িত্ব দিলেন।

শুরুতেই আমি করোনা রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স চালক এবং সহকারীর অভিজ্ঞতা, তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি- এসব গল্প নিয়ে প্রতিবেদন করা শুরু করলাম। এ ধরনের প্রতিবেদন করতে গিয়ে আমাকে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। কারণ এরই মধ্যে ওই এলাকার মানুষ জেনে গিয়েছিল যে, এ অ্যাম্বুলেন্সগুলো করোনা রোগী বহন করে। ফলে কেউ তার বাড়ির সামনে ওই অ্যাম্বুলেন্স থামাতে দেখলেই আপত্তি জানাত।

এমনকি আমাকে একটা খোলা মাঠ বেছে নিয়ে সেখানে ওই অ্যাম্বুলেন্সের চালক এবং সহকারীদের সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছে। যদিও পরে এলাকার লোকজন বিষয়টি মেনে নিয়েছিল। তখন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত আমি বিভিন্ন করোনা কেস নিয়ে প্রতিবেদন করছি। বিশেষ করে করোনা রোগীর দাফনসংশ্লিষ্ট রিপোর্ট করতে গিয়ে আমাকে খিলগাঁও কবরস্থান, আজিমপুর কবরস্থান এবং পোস্তগোলা শ্মশানে গিয়ে অনেকগুলো খবরের প্রতিবেদন করতে হয়েছে।

সত্যি কথা বলতে কি এ ধরনের খবর করতে গিয়ে আমি একটুও ভয় পাইনি বরং আমি বিষয়টিকে আমার পেশাগত দায়বদ্ধতা হিসেবে বিবেচনা করেছি। এমনকি প্রায় সব সাংবাদিকই কোনো একটি দুর্যোগ বা ক্রান্তিকালে তাদের বেস্ট পারফরম্যান্স করে দেখাতে চান। সেদিক থেকে ভাবলে আমিও করোনাকালীন আমার সেরা কাজটা করে দেখাতে চাচ্ছি। যদিও পুরো পৃথিবীর জন্য এটি একটি দুর্যোগ। কিন্তু আমি এই মহামারিকে একটি সম্ভাবনা বা নিজের পেশাগত দক্ষতা প্রমাণের সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছি।

আপনি যখন জানতে পারেন আপনার কোনো সহকর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, তখন আপনার কি মনে হয়?

- যেহেতু আমি অনেক দিন ধরে সাংবাদিকতা পেশায় আছি; তাই যখন শুনি যে আমার কোনো সহকর্মী অথবা অন্য নিউজরুমের কোনো সাংবাদিক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, বিষয়টি আমার কাছে খুব অস্বাভাবিক কিছু মনে হয় না। যেমন- কিছুদিন আগে আমার একজন সহকর্মী করোনায় আক্রান্ত হন এবং আমি ও আমার অন্য সহকর্মীরা মিলে তার যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করেছি। কিন্তু যে বিষয়টি আমাকে শঙ্কিত করে তোলে তা হলো- যদি আমার কোনো সহকর্মীর মাধ্যমে আমিও করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হই তাহলে আমাকেও আইসোলেশনে যেতে হবে এবং আমিও ডিউটি করতে পারব না।

করোনাভাইরাস নিয়ে নিউজ কাভার করতে গিয়ে আপনি কোনো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন?

- এখন পর্যন্ত আমি সরাসরি তেমন কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হইনি। তবে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। যেমন- আপনি কেন এমন একটি পেশায় আছেন; যেখানে আপনাকে স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। আপনার কি দরকার এমন প্রতিবেদন তৈরি করার। এছাড়া কাজে যাওয়ার সময় যখন অফিসের গাড়িতে উঠি তখন আশপাশের মানুষ একটু ভিন্ন দৃষ্টি অথবা আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকায় এবং এই তাকানোটা খুব একটা স্বাভাবিক তাকানো নয়।

করোনাকালীন আপনার পরিবার আপনার পেশাকে কীভাবে দেখছে?

- এমন দুর্যোগকালীন সময়ে আমার পরিবার আমাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করছে। পরিবারের দিক থেকে আমি এখন পর্যন্ত কোনো বাধার সম্মুখীন হইনি। তবে আমি কিছুটা চিন্তিত; যেহেতু আমার বয়স্ক মা আমার সাথে আছেন। একই সঙ্গে এই লকডাউনের সময়ে আমাকে আগের চেয়ে অনেক বেশি ফোনে কথা বলতে হয়- এ বিষয়ে পরিবার থেকে প্রায়ই অভিযোগ জানায়।

এভাবে কাজ করে যাওয়ার পেছনে আপনাকে কোন বিষয়টি সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা দিচ্ছে?

- ‘মানুষের জন্য কিছু করতে চাই’ এ বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করে। আমি মনে করি, এখনই সবচেয়ে উপযুক্ত সময় মানুষের জন্য কিছু করার। নিজের কাজের মাধ্যমে মানুষকে সাহায্য করার -এর চেয়ে ভালো সময় আর নাও আসতে পারে। মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছে দেওয়াটা এখন সবচেয়ে জরুরি।

এই লকডাউনকালীন আমি সহকর্মীদের সাথে প্রতিনিয়ত হোয়াটস অ্যাপ, মেসেঞ্জারের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখছি এবং কাজ নিয়ে পরিকল্পনা করছি। দুই আড়াই ঘণ্টার বেশি সময় আমরা ‘আউট অব কমিউনিকেশন’ থাকি না এবং চেষ্টা করি কোনো না কোনো ভাবে কানেক্টেড থাকার।

আপনার কোনো সহকর্মী করোনা রিলেটেড দায়িত্ব পালন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন?

- হ্যাঁ! বিভিন্ন চ্যানেলের নিউজরুমের অনেকেই করোনাসংশ্লিষ্ট অ্যাসাইনমেন্ট নিতে চাচ্ছে না। সত্যি কথা বলতে কি আমি বিষয়টিকে একটু ভিন্ন ভাবে দেখছি। আমার মনে হয়, অন্য যেকোনো জায়গার চেয়ে হাসপাতাল অথবা কবরস্থানে আমি তুলনামূলক ভাবে নিরাপদে আছি। কারণ এ জায়গাগুলোতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকার ফলে সবাই অনেক বেশি সচেতন থাকে এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি মেনে চলে।

সাংবাদিকরা এ সময়ে কোনো ইনসেনটিভ বা স্পেশাল বোনাস ডিজার্ভ করে?

- মানুষকে খবর জানানোই আমার কাজ বা পেশা, আমি আমার পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য কোনো রকম ইনসেনটিভ বা বোনাস আশা করতে পারি না। এমনকি কেউ যদি এসব দাবি করে তাহলে বিষয়টি অবমাননাকর। কোনো সৈনিক কি যুদ্ধ করার বিনিময়ে কোনো বিশেষ বোনাস আশা করে! তাহলে সাংবাদিকরা দায়িত্ব পালনের জন্য ইনসেনটিভ আশা করবে কেন?

সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার কীভাবে সহযোগিতা করছে?

- সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এখনো সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। আমার মনে হয় করোনা মহামারি থেকে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো নিয়ে হয়তো ভবিষ্যতে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে সরকার। যদি প্রত্যেকটি হাসপাতালে সরকার একজন করে ফোকাল পারসন নিয়োগ করতে পারত তাহলে তথ্য প্রবাহের বিষয়টি আরো কার্যকরী হতো। তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে সরকারের স্বচ্ছতা নিয়ে আমি কথা বলতে চাই না। কারণ স্বচ্ছতার ব্যাপারে কথা বলতে হলে আগে আমাদের জানতে হবে যে কোন বিষয় অস্বচ্ছ হিসেবে বিবেচিত।

লেখক: প্রকল্প কর্মকর্তা, সাউথ এশিয়া সেন্টার ফর মিডিয়া ইন ডেভেলপমেন্ট (সাকমিড)

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।