ও আমার দেশের পণ্য, তোমার তরে...
আহসান কবীর
মন খারাপ ভাবটা কেটে গেল মুহূর্তেই। কীভাবে তা বলার আগে বলে নেই মনটা খারাপ ছিল কেন! কাঠমুন্ডুর বাবরমহল রোডের এক রেস্টুরেন্টে বসেছিলাম। দেশি এক ভাইয়ের জন্য বিদেশে থাকা দেশীয় এক অফিসে তদবিরে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে মেজাজ খাট্টা হয়ে যায়।
এখানে সামনে বসা নেপালি দুই আইনজীবী। এদের একজন আবার ল` কলেজের শিক্ষক। ওদিকে বাংলাদেশি অফিসের প্রধান কর্মকর্তা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু তার অধীনস্থ এক কর্মকর্তার অসোয়াসা ভরা মনোবৃত্তির কারণে মনে হয় তিনি বিভ্রান্ত হয়েছেন।
যার জন্য তদবিরে গেছিলাম, রেস্টুরেন্টে সে বসা আমার পাশে। মুখটা শুকনো, তাকানো যায় না!
একেতো বিষয়টি নিয়ে মেজাজ খিঁচড়ে আছে, ওদিকে বিষয়টি নিয়ে নেপালি আইনজীবীর কথা- “তোমাদের দেশের `ওই অফিস` চাইলেই তো হেল্প করতে পারে!”
আমি এর আগে চাকরি সূত্রে কিছুকাল প্রবাসে কাটিয়েছি। তখন দেখেছি, আমাদের `ওই অফিসগুলো`র ভয়াবহ অসহযোগিতার কদর্য রূপ। তাই মুখে তালা মেরে রইলাম।
আফটার অল, দু`জন বিদেশির সামনে এ বিষয়ে, এটাই উত্তম পন্থা। নিজেদের ঘিনঘিনে চেহারাটা আমার নীরবতা দিয়ে ঢেকে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করি। কিন্তু নেপালি আইনওয়ালা এবার শুরু করলো ওই অফিসের বাংলাদেশি কয়েকজন এবং এক নেপালি কর্মকর্তার অসহযোগিতা আর খামখেয়ালির বয়ান। যেহেতু আইন ব্যবসা করেন, তাই এসব বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা খারাপ না।
গরমের দুপুরে ঠাণ্ডা স্লাইস খাচ্ছিলাম। কিন্তু পানীয়ের স্বাদ উপভোগ্য হয়ে উঠতে পারছিল না পরিবেশটার কারণে। লোকটার পেশাগত জ্ঞান আর সৌজন্যবোধের জন্য তাকে আমাদের ভালো লেগেছে। কিন্তু তারপরেও তার কথা যত যৌক্তিক আর সত্যই হোক, ভাল লাগছিল না। নিজের পরিবার-প্রিয়জন আর দেশের বা দেশের লোকের বদনাম কারই বা ভাল লাগে। আমি অন্যদিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরাই, এদিক ওদিক তাকাই।
এসময় রেস্টুরেন্টটির ক্যাশ কাউন্টারের পেছনের কাঁচের আলমারিতে চোখ যেতেই চমকে উঠি, ভাল করে তাকিয়ে দেশি-বিদেশি অনেক পানীয়ের মাঝে আমাদের দেশীয় পণ্য প্রাণ জুসের প্যাকেট। দেখে এক লহমায় মন খারাপ ভাবটা দূর হয়ে যায়।
আমি দাঁড়িয়ে যাই, টেবিল থেকে উঠে ক্যামেরাটা অন করি। ওদিকে নেপালি আইনবিদ তার বয়ান মাঝপথে থামিয়ে দেন। আমি টেবিল ছেড়ে এগিয়ে যাই শোকেসের দিকে। ছবি তুলতে থাকি একের পর এক। কাউন্টারে থাকা তরুণ ম্যানেজার একটু অপ্রস্তুত হয়। তাকেসহ কয়েকটা স্ন্যাপ নেই এবার।
তিনি জানালেন, বিগত কয়েক বছরে নেপালে প্রাণের নানান পণ্যের ভাল মার্কেট তৈরি হয়েছে। প্রাণ এখানেই কারখানা বসিয়ে এসব তৈরি করছে।
মনে পড়লো আখাউড়ার সাংবাদিক দুলাল ঘোষের কথা। তার কাছে শুনেছিলাম ভারতের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্য তথা সেভেন সিস্টার্স-এ প্রাণের জুস, বিস্কিট, চানাচুরের রমরমা বাজারের কথা। ভারতীয় ওই রাজ্যের মানুষ প্রাণের পানীয়কে কোক-পেপসির তুলনায় নিজেদের পণ্য মনে করে।
আগেরদিনই নেপালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে শামসও একই কথা জানিয়েছেন আমাকে। তিনি বলেছেন, এদেশে বাজার ছোট হলেও বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা রয়েছে। প্রাণ ছাড়াও ওয়ালটনের কথা বললেন। বেশ কয়েকটি শো-রুম আছে তাদের এখানে। বাংলাদেশের ইলেক্ট্রনিক্স জায়ান্ট ওয়ালটনও বাজার পেয়ে গেছে প্রায়। মনে পড়লো কাঠমুন্ডুর একা রাস্তায় ট্যাক্সি করে যাওয়ার সময় ওয়ালটনের একটা শোরুম আমিও দেখেছিলাম। আফসোস হলো, কেন একটি ছবি তুলে রাখলাম না!
বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের অনেক বদনাম আছে, দোষ আছে। তবে সবকিছু ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতে আমাদের ব্যবসায়ীদের সাফল্যের নমুনা দেখে মনটা ভালো না হয়ে পারলো না। সাবাশ প্রাণ! সাবাশ ওয়ালটন!
কে বলেছে বঙালি ব্যবসা বোঝে না! আমার মন বলছে, বাংলার ছেলে বিজয় সিংহ ঠিকই লঙ্কা জয় করেছিলেন...
- লেখক ও সাংবাদিক