মা, তুমি ভালো থেকো
রাফে সাদনান আদেল
আমার ঈদ মানেই মা। আমাদের ঈদের শুরু থেকে শেষ অবদি পুরো জুড়েই থাকতেন মা। আমার মা আমাদের সাথে করে নিয়ে যেতেন সবসময় নতুন জামা কিনে দিতে।
বাবা খানিকটা বদ-মেজাজি ছিলেন। ঘন্টার পর ঘন্টা ঈদ কেনাকাটায় মার্কেটে ঘোরাঘুরি করার ধৈর্য্য তার ছিল না। মা এদিক দিয়ে অনেক এগিয়ে তার মোটেই অনাগ্রহ নেই। আমরাও মায়ের সাথে ঘুরতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য ছিল।
এদিকে, আর দশটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই আমাদেরও ঈদের কেনাকাট হতো একেবারই ঈদের শেষ দিকে। তখন দুটো সমস্যা হতো কোনো জামা পছন্দ হলে তার সাইজ পাওয়া যেত না! আমাদের এই নিয়ে মন খারাপ হতো কখনো কখনো মেজাজও।
সবচেয়ে মজার ব্যপার হলো আমার ছোট বোনটা ছিল খুব খুঁতখুতে অনেক পছন্দ করে জামা কেনার পর বাড়ি এসেই তার উচ্ছাস চলে যেত প্রায় প্রতিবার। কেন না কোনো এক অজানা কারণে বাড়িতে আসার পরই তার আর ঐ জামা পছন্দ হতো না; আর তার জের ধরেই প্রায় প্রতি ঈদের চাঁদ রাতেই সে বাবার সাথে বের হতো আবারো কেনাকাটায় আর বিনিময়ে আরেকটা জামা বেশিও পেয়ে যেত।
আমাদের অবশ্য সে নিয়ে মন খারাপ হতো না খুব একটা। আর আমার ছেলে বেলা থেকেই কেন যেন ঈদে নতুন পোশাকের দিকে খুব একটা ঝোঁক ছিল না। ঈদের দিন ঘুম থেকে উঠাতেন আম্মা তারপর শীতের সকালে গোছল উফ্... নামাজ পরতেই হবে আম্মার কড়া নির্দেশ... অগত্যা কাষ্ঠমুখে গোসল.. অবশ্য ছোট ভাই কুম কুম গরম পানির পক্ষপাতিত্ব না পেলেও আম্মা প্রায়ই আমাকে গোসলের জন্য করে দিতেন গরম পানি।
এরপর নামাজ থেকে ফিরে দেখতাম আম্মাকে সালাম করা, সালামি নিয়েই হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের সাথে। তখন কতো কম টাকায় কতো জায়গায় ঘুরে আসতাম ঢাকার কতো দিক ঠিক নেই... আর সবসময়ই ঈদে ঢাকা একেবারেই অন্যরকম... গ্রামের বাড়িতে খুব একটা যাতায়াত না থাকায় আমাদের প্রায় সব ঈদ করতে হয়েছে ঢাকায়।
মামা আর খালারা থাকতেন মতিঝিলে, সালামির উদ্দেশ্যেই একবার ঢু মারতাম ব্যাংক পাড়ার পাশের সরকারি কোয়ার্টারগুলোতে পালা করে। আবারো ঘুরান্তিস... এভাবে টো টো করে ঘুরে রাতে আবারো ফিরতাম মায়ের কোলে... মা`র সারাদিনের কষ্ট করে করা রান্নাগুলো তা তখন আমাদের খুব আগ্রহ নিয়ে খাওয়াতেন আর বিরবির করতেন দুপুরে একবার ঘুরে গেলে কি হতো...
আম্মার ধারণা ছিল সকালে রান্না করা খাবারগুলো দুপুরে আর সেই আগের স্বাদ থাকতো না.. কিন্তু রাতেও সেই অমৃতসম খাবার আজ কোথায়..! কোথায় সেই ঈদ! আম্মাকে অনেক স্নিগ্ধ লাগতো ঈদের দিন, সম্ভবত নতুন শাড়ির জন্য। একটু যখন বড় হই আমার মনে আছে আমি তখন এইচএসসি ২য় বর্ষে তখন আমি টিউশনি করি। জামা কাপড়ও কিনি বন্ধুদের সাথেই।
হঠাৎ একদিন বেইলি রোড থেকে আম্মার জন্য ঈদে একটা শাড়ি কিনে ফেললাম, আজও মনে আছে, হালকা গোলাপি রঙের মধ্যে সাদা কাজ করা একটা নগণ্য সুতি শাড়ি। আহ বাড়ি ফেরার পর মা`র হাতে দিলাম অনেক অকারণ লজ্জায়।
আম্মা বুকে জড়ায় ধরে আদর করলেন আর বার বার শাড়িতে হাত বুলিয়ে বলছিলেন আমার বাবা বড় হচ্ছে। সেই আদরের লোভে এরপর থেকে প্রতি ঈদেই আমি মা`র জন্য শাড়ি কিনতাম। আর মা আমার শাড়িটাই প্রথম পরতেন। আম্মার স্নিগ্ধতা দেখে আমার মন জুড়িয়ে যেত। আর কোরবানি ঈদে আমার বাবার কাণ্ড দেখে মাথা নস্ট হয়ে যেত; আর উপভোগ করতাম ছোট ভাইটার কুরবানির পশুকে ঘিরে উন্মাদনা!
আব্বা রীতিমত এদিনে কসাই বনে যেতেন; বদমেজাজি হবার কারণে মৌসুমী কসাইদের সাথে তার ঝগড়া বেঁধে যেত। এরপর থেকে তিনি নিজেই কসাই বনে যেতেন সাথে আমি আর আমার ভাই সেক্রেটারির দায়িত্বে। আস্ত ছাগল ঝুলিয়ে টেনে ছিলে ফেলার ব্যার্থ চেষ্টায় আমাদের হাসিতে তার ঘামও ঝরতো বাড়তো রাগও। আর গরুর একপাশের চামড়া ধরে রাখার দায়িত্বে আমাদের অবহেলায় সেই রাগ উঠতো চরমে। তবে সেসব দিন আজ শুধুই স্মৃতি।
আমার মায়ের কলিজা ভুনা...আহ... ঈদের স্মৃতিচারণ আসলেই অনেক কঠিন; অনুরোধের দাম দিতে গিয়ে অনেক চোখের পানি ঝরলো.. অনেকের হয়তো ঈদের আনন্দতেও ভাটা পরলো... কিন্তু এজন্যই লিখলাম কারো বাবা-মাই চিরদিন থাকবেন না .. জীবনের এই বাস্তবতাটাকে মেনে নিয়েই আমরা যেন যতটুকু সম্ভব মা-বাবার সাথে ঈদ করি--আমার এইটুকুন অনুরোধ।
কে জানে বা বলতে পারে আল্লাহ মাফ করুন হয়ত সামনের ঈদের আনন্দটা আপনার মলিন হয়ে যাবে আমার মতো... মা, তুমি ভালো থেকো , ঈদ মোবারক! -সাংবাদিক