জ্যৈষ্ঠ মাস কি আসলেই মধুমাস?

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ সালাহ উদ্দিন মাহমুদ , লেখক ও সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০১:৫৮ পিএম, ১৭ মে ২০১৮

এখন জ্যৈষ্ঠ মাস। পত্রপত্রিকা খুললেই দেখবেন- ‘চলছে মধুমাস’ শিরোনাম। কোনো কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানও জ্যৈষ্ঠ মাসকে ‘মধুমাস’ হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছেন। তবে প্রশ্ন উঠতে পারে- তাহলে মধুমাস আসলে কোনটি? এ প্রশ্নের উত্তরে অভিধান বলছে, চৈত্র মাস হচ্ছে মধুমাস। যুগ যুগ ধরে এমনটিই ব্যবহৃত হয়ে আসছে সাহিত্যে। হঠাৎ করেই জ্যৈষ্ঠ মাসের ফলে ঘ্রাণে সংবাদপত্রগুলো একে মধুমাস বানিয়ে দিলো। সেই থেকে এখন জ্যৈষ্ঠ মাসই মধুমাস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বর্তমানে দেশের পত্রপত্রিকায় জ্যৈষ্ঠ মাস নিয়ে কোনো কিছু লিখতে গিয়ে লেখা হয়, ‘মিষ্টি ফলের রসে ভরা মধুমাস’। এভাবেই জ্যৈষ্ঠ মাসের সঙ্গে মধুমাস বিশেষণটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। তারা বোঝাতে চান- জ্যৈষ্ঠ মাসে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, আনারস, তরমুজ, ডেউয়া, লটকন, গোলাপ জাম, বেতফল, গাব, জামরুল, আতাফল, কাউ, শরীফা প্রভৃতি ফল পাওয়া যায়। ফলের এই মৌ মৌ ঘ্রাণে জ্যৈষ্ঠ মাস তাদের কাছে হয়ে উঠেছে মধুময়।

লেখক, গবেষক ও ইতিহাসবিদ ড. মোহাম্মদ আমীন বলেছেন, ‘মধুমাস শব্দের অর্থ চৈত্র মাস। অনেকে জ্যৈষ্ঠ মাস অর্থে শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন। এটি অশুদ্ধ। মধুমাস কেবল চৈত্র মাসকে বোঝায়। অন্যদিকে ‘মধুফল’ বলে কোনো শব্দ বাংলা অভিধানে নেই। তবে বৃন্দাবনের একটি বনের নাম ‘মধুবন’। কিন্তু ‘মধুফল’ নামের কোনো ফল কোথাও নেই।’

বাংলাদেশি মিডিয়ায় আশির দশক থেকে ‘জ্যৈষ্ঠ মাস’ অর্থে শব্দটির ঢালাও ব্যবহার শুরু হয়েছে। এ কারণে শব্দটি তার মূল অর্থ ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছে। ধারণা করা হয়, জ্যৈষ্ঠ মাসে আম, জাম, কাঁঠালসহ একাধিক মিষ্টি ফল পাকে বলেই প্রয়োগকারীরা ভুলবশত ধরে নিয়েছেন, মধুমাস মানেই জ্যৈষ্ঠ মাস। অথচ দৌলত উজির বাহরাম খান তার কাব্যে বলেছেন, ‘মধুমাসে উতলা বাতাস, কুহরে পিক; যদি সে কমল শিশিরে দহল কি করিব মধুমাসে।’ এখানে তিনি চৈত্র মাসের কথাই বলেছেন। কারণ জ্যৈষ্ঠ মাসে কোকিল ডাকে না।

jagonews24

প্রাচীন কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীও চৈত্র মাস অর্থেই মধুমাস শব্দটি ব্যবহার করেছেন, ‘মধুমাসে মলয় মারুত মন্দ মন্দ। মালতীর মধুকর পিয়ে মকরন্দ।’ এদিকে চণ্ডীদাসও চৈত্র মাস বা বসন্তকাল অর্থে মধুমাস শব্দটি ব্যবহার করেছেন, ‘মধুমাস আপায় মাধব পরশে।’ এখানে আপায় মানে ‘গত হয়’। এছাড়া খনার বচনেও মধুমাস বলতে চৈত্র মাসকেই বোঝানো হয়েছে, ‘মধুমাসে প্রথম দিনে হয় যেই বার/ রবি শোষে মঙ্গল বর্ষে, দুর্ভিক্ষ বুধবার।/ সোম শুক্র শুরু আর/ পৃথ্বী সয় না শস্যের ভার॥/ পাঁচ শনি পায় মীনে/ শকুনি মাংস না খায় ঘুণে।’

কবিতার পঙক্তি ছাড়াও অভিধান মতে, ফাল্গুন ও চৈত্র মাস মিলে হয় বসন্তকাল। আবার মধু বলতেও এই বসন্তকালকেই বোঝানো হয়েছে। অন্যদিকে বসন্তের সখা কোকিলের আরেক নাম হচ্ছে ‘মধুসখ’। এছাড়া হিন্দিতে ‘বাহারী’ মানে মধুকাল বা মধুমাস। আবার ‘বাহারকে দিন’ মানে বসন্তকাল। অন্যদিকে ফারসিতে ‘বহার’ মানে বসন্তকাল, ‘বহারী’ অর্থ বাসন্তী বা বসন্তকাল সম্বন্ধীয়। ফলে বলাই যায় যে, পত্রপত্রিকা যে মধুমাস পালন করছে, সেটা পক্ষান্তরে ভুল বোঝাবুঝির ফল।

তবে এ কথা সত্য যে, সময়ের ব্যবধানে শব্দের অর্থের অবনতি হতেই পারে। বাংলার আধুনিক ‘মধুমাস’ তারই প্রমাণ। তাই এখন আর মধুমাসের আভিধানিক অর্থ মনে করিয়ে দিয়ে লাভ নেই। হয়তো আগামীতেও এই ভুল সংস্কৃতিই পালিত হতে থাকবে। একসময় এটিই মানুষের ধ্যানে-জ্ঞানে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে।

এসইউ/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।