ঈদ আনন্দ ফিকে যেখানে
বিছানার বিপরীত দেয়ালে টাঙানো ছবিটি যেন বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের কথা বলতে চাইছে। চোখ ঠুকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে তারুণ্যের প্রভা। কপালে বড় টিপ। বেনী করা চুলের আঁটি, যেন যৌবনের পরিপাটি ঢংয়ের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। প্রিন্টের শাড়ি আর বড় হাতার ব্লাউজ পরা সাদাকালো ছবিটিতে রীতিমত বাঙালিয়ানার ছাপ। চোখে-মুখে সুখ-স্বপ্নের হাতছানি।
দেখে ঠাহর করার জো নেই, বিছানায় শুয়ে থাকা বৃদ্ধা মিরা চৌধুরীর ছবি এটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে পাস করার পরপরই ছবিটি তুলেছিলেন বলে জানালেন বৃদ্ধা।
আসন্ন ঈদ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ছবির কথাই আগে জানতে হলো। ছবির ইতিহাস আশির দশকের প্রথম দিকের। ওটি নিত্যদিন অতিযত্নে পরিষ্কার করে রাখেন মিরা। জীবনের একাকীত্বের এ বেলায় তারুণ্যের ওই ছবিটিই তার একমাত্র বন্ধু। ওতেই নিজেকে খুঁজে ফেরেন মিরা।
‘ঈদ’ শব্দটি বলতেই ছলছল চোখে মিরা বলেন, ‘বৃদ্ধাশ্রমে থেকে ঈদের কথা ভাবতে নেই। বড় কষ্ট হয়। আনন্দ! সে তো অনেক আগেই জীবন থেকে হারিয়ে গেছে।’
আগারগাঁওয়ে শের-ই বাংলা নগরের বৃদ্ধাশ্রমে (বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ) সাড়ে তিন বছর আগে এসেছেন মিরা চৌধরী। আদি নিবাস কলকাতার জাকারিয়া স্ট্রিটে। বিশাল সহায়সম্পত্তি সেখানে। চাচাতো ভাইবোনেরা দেখভালের দায়িত্বে।
একমাত্র ছেলে অপূর্ব হাছান চৌধুরী আমেরিকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি পড়া শেষ করে ডিগ্রি নিতে বিদেশ গমন ছেলে অপূর্বের। কবে আসবে জানে না বৃদ্ধা। স্বামী যোশেপ চৌধুরী আইএলও (ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন)-এর ডিরেক্টর ছিলেন। পাঁচ বছর আগে অফিসরত অবস্থায় স্ট্রোক করে মারা যান তিনি।
একমাত্র ভাইও গত হয়েছেন বেশ কিছুদিন আগে। আপন বলতে কেউ নেই দেশে। ইস্কাটনে দিলু রোডের বাসাটিও বিক্রি করে দিয়েছেন অনেক আগেই। ব্যাংকে জমানো টাকা থেকে বৃদ্ধাশ্রমের খরচ চালিয়ে আসছেন মিরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতির ওপর মাস্টার্স পড়ে শিক্ষকতা করেছেন খুলনা মহিলা কলেজে। উচ্চশিক্ষিত এই মানুষটিকে বড়ই বেমানান লাগছিল বৃদ্ধাশ্রমের নির্জন কক্ষটিতে।
বলছিলেন, ‘এখানে আসার পর সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে গেছে। লাঠিতে ভর করে হাঁটতে হয়। এবার ঈদে বাইরে হঁটতেও পারবো না। কাকে সঙ্গে নেবো? আমি ছাড়া তো আমার কেউ নেই। সব-ই কপালের লেখা।’
মিরা চৌধরীর কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসতেই বারান্দায় বসে থাকা আশি-ঊর্ধ্ব এক বৃদ্ধকে চোখে পড়লো। দাঁড়ি-চুল সব-ই পাকা। সফেদ পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরা মানুষটি ধীর গতিতে তসবি তেলাওয়াত করছেন। চোখে চোখ পড়তেই ডেকে কাছে বসালেন।
সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কৌশলে নিজের নামটি এড়িয়ে গেলেন। বলছিলেন, ‘মিডিয়ায় নাম প্রকাশ পেলে আমার সন্তানদের বিড়ম্বনা বাড়তে পারে। বাবা বৃদ্ধাশ্রমে এটি জানলে, ছেলে-মেয়েদের বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মীরা নানা প্রশ্ন করতে পারে। এতে ওরা কষ্ট পাবে, যা আমাকেও বড় কষ্ট দেবে। এ কারণেই নাম বলতে চাইছি না।’
বৃদ্ধ ৯ বছর ধরে আছেন অাগারগাঁওয়ের এই আশ্রমে। পিডিবির প্রকৌশলী ছিলেন। ১৯৯৯ সালে অবসরে যান। চট্টগ্রাম শহরে বাড়ি। বড় মেয়েকে ডাক্তারি পড়িয়ে আমিরেকায় পাঠিয়েছিলেন। সেখানে আইটির ওপর ডিগ্রি নিয়ে কানাডায় ব্যাংকে চাকরি করছেন। ছেলে ঢাকায় সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক। ছেলের স্ত্রীও চাকরি করেন। ছোট মেয়ে সিলেটের একটি স্কুলের শিক্ষক।
পরিচয় জানতে না চেয়েই ঈদ প্রসঙ্গে কথা হয়। বলেন,‘ জীবন থেকে সব আনন্দ-ই হারিয়ে গেছে। ঈদের দিনকে অন্য দিন থেকে আলাদা করে মনের কষ্ট বাড়াতে চাই না। নয় বছর ধরে এই আশ্রমে আছি। ঈদের দিনও এখানেই কাটে। বেশ আছি।’
কথা বলার মাঝে-ই অভিমানের অশ্রুতে চোখ যেন ভরে উঠলো। চোখের পানি মুছতে মুছতেই বললেন,‘সব থেকেও আমার যেন আজ কিছুই নেই। আমার রক্ত পানি করা টাকায় বিশাল বাড়ি, অথচ ওই বাড়িতে আমার-ই ঠাঁই নেই। পেনসন থেকে পাওয়া টাকা দিয়েই আশ্রমের খরচ চালাই। বেশ আছি। আশ্রম-ই এখন আমার পরিবার। এখানে অনেকেই আছেন, যাদের কষ্ট আমার থেকেও অনেক বেশি। ঈদের আনন্দ না হয়, তাদের সঙ্গেই ভাগাভাগি করবো।’
এএসএস/বিএ/আরআই