পারিলের ঐতিহ্যবাহী নৌকা বাইচ

মিয়াজান কবীর
মিয়াজান কবীর মিয়াজান কবীর , লেখক ও গবেষক
প্রকাশিত: ০৮:৫৭ এএম, ০৪ অক্টোবর ২০১৭
ছবি : মোজাম্মেল হোসাইন খান

নদীমাতৃক বাংলাদেশ। নদীর তীরে তীরে গড়ে উঠেছে জনপদ। নদী আর জীবন যেন সমান্তরালভাবে বয়ে চলে। এ দেশে চলাচলের জন্য সুপ্রাচীন কাল থেকে নৌকা হয়ে উঠেছে সঙ্গী। নদী পারাপারে কিংবা দূরে কোথাও যেতে নৌকা ছিল একসময় প্রধান বাহন। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেও নৌকা ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ইছামতি নদীর তীরে যাত্রাপুর, ডাকছড়া দুর্গ থেকে মুসা খাঁ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল মুঘল বাহিনীর সুবেদার ইসলাম খাঁর বিরুদ্ধে। স্বদেশী আন্দোলনের আত্মত্যাগী তরুণরাও ছিপনৌকা নিয়ে মুনাফাখোর মহাজনদের কাছ থেকে ডাকাতের ছদ্মাবরণে অর্থ সংগ্রহ করতেন। সে সব লুণ্ঠিত টাকা দিয়ে অনুশীলন, যুগান্তর নামে স্বদেশী সংগঠনকে করেছেন শক্তিশালী।

নদী আর নৌকা এদেশের মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ হয়ে আছে। অথচ কালের প্রবাহে নদী হারিয়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে সঙ্গে নৌকাও বিলীন হওয়ার পথে। তবুও এ দেশে এখনও ভাটি অঞ্চলে কিংবা নদীঘেরা জনপদে পারাপারে নৌকার প্রচলন দেখা যায়। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ধলেশ্বরী, ইছামতি, কালিগঙ্গা, বংশাই এখনও ক্ষীণ ধারায় বহমান। এসব নদীর যেমন রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম; তেমনি ছিপ, জলকা, ঘাসি, ছান্দি, খেলনা, ময়ূরপঙ্খী, ডিঙি, কোশা, সপ্তডিঙ্গা মধুকর নৌকার নামগুলো কত কাব্যময়।

miajan

লোক-ঐতিহ্যে ভরপুর এ দেশ। এই লোক-ঐতিহ্য বাঙালির অতি প্রিয়। তাই বারো মাসে তেরো পার্বণ পালিত হয়ে থাকে এই বাংলায়।

বর্ষায় শ্রমজীবী মানুষ অবসর সময় কাটায়। এ সময় চাষাবাদ বা কাজকর্ম থাকে না। ধানকাটা মৌসুম চলে যায়। অবসর সময়ে বাংলার খেটে খাওয়া মানুষ নৌকা বাইচের উৎসবে মেতে ওঠে। ভাদ্র মাসে নদীর বুকে পানি যখন শীতল ধারায় বয়ে চলে, তখনই শুরু হয় নৌকা বাইচের আয়োজন। বাংলার কৃষক-শ্রমিক-মজুর-মাঝি-মাল্লা নৌকা আর বৈঠা নানা রঙে সাজায়। অপেক্ষায় থাকে কবে হবে তাদের কাঙ্খিত নৌকা বাইচ। তারপর দিনক্ষণ মতে নির্দিষ্ট জায়গায় সারি গান গেয়ে গেয়ে বৈঠার তালে তালে নৌকা বেয়ে ছুটে যায় বাইচ দিতে।

মানিকগঞ্জ অঞ্চলেও রয়েছে অসংখ্য নদী-নালা, খাল-বিল। একসময় এসব নদী-নালা, খাল-বিলে নৌকা বাইচের মহাসমারোহ দেখা যেত। কালের বিবর্তনে নৌকা বাইচের ভাটা পড়লেও এখনও কোন কোন জায়গায় নৌকা বাইচের উৎসব দেখা যায়। তার মধ্যে পারিল গ্রামে প্রায় একশ’ বছর ধরে নৌকা বাইচ হয়ে আসছে। পারিল গ্রামটি অতি প্রাচীন। সুলতানি আমলে শাহ মোবারক উজিয়াল পরগনার তপ্পে পারিল নামে ইতিহাসের পাতায় আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে। ভৌগলিক দিক থেকে রয়েছে স্বাতন্ত্র্য। ছোট ছোট উঁচু উঁচু টিলার উপর ঘর-বাড়ি গড়ে উঠেছে। বর্ষায় ডোবা-নালা ভরে চারিদিকে থৈ-থৈ পানির নহর দেখা যায়। তাই পারিল গ্রাম নিয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ছড়া কাটে-
‘ডোবা নালা গারা,
নওয়াধা-পারিল বলধারা।’

miajan

লোকজ ধারায় পারিল গ্রামটি আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল। পারিল গ্রামে বহুকাল ধরে নৌকা বাইচের উৎসব হয়ে আসছে। দূর-দূরান্ত থেকে সৌখিন মাঝি-মাল্লারা ‘হেইও হেইও’ বলে তালে তালে নৌকা বেয়ে চলে আসে এই পারিল গ্রামে। মনের আনন্দে মাঝি-মাল্লারা গায় সারি গান-
‘বৈঠা টান দিওরে বেলা বইয়া গেল,
পাছের নাও আগে চইলা গেল,
বৈঠা টান দিওরে, হেইও হেইও।’
কিংবা
‘বাইচ দিবারও গেছিলাম পারিলাগো খালে,
পারিলারা বইসা রইছে বৈন্যা গাছের তলে-
আহা বেশ বেশ বেশ।’

বাংলার নদী-নালায় একসময় নৌকা বাইচের উৎসবে দেশের মানুষ আনন্দে মেতে উঠতো। নদী তার নাব্যতা হারিয়ে মরা গাঙে পরিণত হয়েছে। বিবর্ণ হয়ে উঠেছে সবুজ বাংলাদেশ। তবুও এদেশের উৎসবপ্রিয় মানুষ সুবর্ণ দিনের স্মৃতি ধরে রাখতে নৌকা বাইচের আয়োজন করে থাকে। পারিলের ঐতিহ্যবাহী নৌকা বাইচ আজও লোক ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে আছে। লোক ঐতিহ্যে অবগাহনে আগামী প্রজন্ম বাঙালি চেতনায় গড়ে উঠবে মন ও মননে, শিক্ষা-দীক্ষায়, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে- এই তো কালের দাবি।

এসইউ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।