নীলার স্বপ্ন ছোঁয়ার চেষ্টা

ফাতিমা তাহসিন
ফাতিমা তাহসিন ফাতিমা তাহসিন , লেখক ও সমাজকর্মী
প্রকাশিত: ০৮:৫৯ এএম, ১৪ আগস্ট ২০১৭

মেয়েটির নাম নীলা। তিন বছর বয়সে বাবা মারা যাওয়ায় নানাবাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করতো। পড়াশোনায় ভালোই ছিলো। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া, আবার বাসায় এসে মায়ের সাথে টুকটাক কাজ করা। ছোট্ট নীলার তো একদিন বড় হতেই হবে।

পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষা দেয়, মেয়েটা আসলেই বড় হয়ে যায়। তবু নীলার স্বপ্ন পূরণের দ্বাররুদ্ধ হয়ে যায়; যখন তার নানাও মারা যান। এখন আর কে নীলাকে শিক্ষিত করে তুলবে? বাবা নেই, নানা নেই, বড় ভাই নেই।

কোনোমতে খেয়ে-পরে বাঁচার জন্য মা, বোনসহ নীলা ঢাকার রায়েরবাজার বস্তিতে চলে আসে। মা-বোন গৃহকর্মী আর নীলা মেট্রো মার্কেটে কাজও শুরু করে। মেট্রোতে টাকা কম পাওয়ায় ওখানে কাজ ছেড়ে দিয়ে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে থাকে। তিন হাজার টাকা প্রতিমাসে। কিছু টাকায় ঘর ভাড়া, বাকি টাকা জমা রাখে ভবিষ্যতের জন্য।

নীলার মতে, ‘যৌতুক ছাড়া কোনো ছেলেই বিয়ে করে না। আমার তো আব্বু নেই। কে যৌতুক দেবে? সে জন্য টাকা জমাইতেছি, টাকা জমায়া দশ বছর পর বিয়ে করবো!’ বেশ গুছিয়ে শুদ্ধভাবে কথা বলতে পারে সুন্দর এই কিশোরী।

nila

টিউশন শেষে রাত নয়টায় হলে এসে বেশ ক্লান্ত ছিলাম। তবু ২১ বছরের হিসাব কষার চেষ্টা করছিলাম কাল রাতে! এতো সুযোগ পেয়েও আমরা স্বপ্ন দেখা ভুলে গেছি, আমাদের অজুহাতের শেষ নেই আর আমাদের সমাজের বহু নীলা আছে যাদের অজুহাত শোনার মতো কেউ নেই। ওরা নিজেরাই গল্প বানায়, আবার নিজের গল্প নিজেই শোনে।

মেয়েটার একসময় স্বপ্ন ছিলো শিক্ষিত আর শিক্ষক হওয়ার। কোনোটাই হতে পারেনি। তবু স্বপ্ন দেখতে ভোলেনি। তাই তিনটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ প্রচেষ্টায় একটি ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণ করে। এখন সে প্রতিদিন গৃহকর্মীর দায়িত্ব শেষে বিকেলে বিভিন্ন সেশনে যায়, যা নিজে শেখে- সেসব আবার বাসার পাশের অন্য বাচ্চাদেরও শেখায়।

নীলা বলে, ‘আমি চাই না আমার মতো আর কারো স্বপ্ন ভেঙে যাক! সেজন্য বাচ্চাদের শেখাই, নিজেও শিখি। ভালো আছি। ছোটো ভাইটাকে কিশোরগঞ্জেই পড়াই, খাই-দাই, শিখি, শেখাই, কাজ করি! ভালোই তো আছি।’

nila

মেয়েটি স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে, আবার ছদ্মনামে ফেসবুক আইডিও আছে। নীলা বলে, ‘আপু, আমাকে রিকুয়েস্ট পাঠায়েন, তবে ফেসবুকে আমি ছবি দেই না। ছবি দিয়ে যদি বাজে ছেলেরা কিছু করে!’ ওর প্রাইভেসি সচেতনতায় সত্যিই আমি মুগ্ধ।

এ রকম বহু নীলা আছে আমাদেরই চারপাশে; হয়তো সময় করে ওদের গল্প শোনা হয় না। তবে হ্যাঁ, একবার খুব কাছ থেকে ওদের গল্প উপলব্ধি করতে পারলে কিছু সম্ভব না হলেও অন্তত যে সুখ পাওয়া যায় তা কোটি টাকা দিয়েও পাওয়া যায় না!

নীলা সুযোগ পেলে পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষিকা হতে চায়। ওর মতো মানুষ যদি সুযোগ পেয়ে শিক্ষিত হতে পারতো, দেশটা সত্যিই এগিয়ে যেত। এতো স্বপ্ন যার চোখে, এতো শক্তিশালী মানসিকতার মানুষ যদি শিক্ষিত হতে পারতো! তবে রাতারাতি সমাজ বদলানো সম্ভব না হলেও অন্তত রাতারাতি নিজের মানসিকতার পরিবর্তন করে ওদের জন্য কিছু একটা করার মানসিকতা তো তৈরি করা যায়!

সত্যি দেশটা একদিন ভরে যাবে শিক্ষিত, কর্মঠ আর সচেতন মানুষে। সেই দিনের অপেক্ষায় নীলার জন্য শুভকামনা।

এসইউ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।