ভোক্তা অধিকার আইনে অভিযোগ করতে চাইলে

মতিউর রহমান ফয়সাল
মতিউর রহমান ফয়সাল মতিউর রহমান ফয়সাল , আইনজীবি
প্রকাশিত: ১১:১৯ এএম, ১৩ আগস্ট ২০১৭

ভোক্তা বলতে আমরা বুঝি যিনি ভোগ করেন বা উপভোগকারী। কিন্তু উপভোগের সামগ্রীগুলো যদি হয় ভেজাল, পরিমাপে ঠকানোর ধান্ধা, নকল পণ্য, অবহেলায় উৎপাদিত ও মেয়াদোত্তীর্ণ, আপনার নিরাপত্তা ও জীবন বিপন্নকারী তবে নিশ্চিতভাবেই তা আপনার জন্য উপভোগের হবে না। আর তা বন্ধে এবং ভোক্তা বা ক্রেতার অধিকার সংরক্ষিত ও বলবৎকরণে, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ পাস হয়েছিল।

এই অধিকার বলবৎকরণে একজন ভোক্তা হিসেবে আপনিও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারবেন খুবই সহজে।

মিস আইশা টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে দেখলেন, ওমুক কোম্পানির রঙ ফর্সাকারী ক্রিম ত্বকে মাখলে তিন মাসের মধ্যে ত্বক ফর্সা ও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। তিনি বাজার থেকে সেই কোম্পানির পণ্য ক্রয়ের পর টানা তিন মাস ব্যবহারের পরেও কোনো ফল পেলেন না। উল্টো তার ত্বক বিভিন্ন ধরনের দাগ ও চর্ম রোগে আক্রান্ত হলো। এই ক্ষেত্রে তিনি ভোক্তা অধিকার আইন অনুযায়ী প্রতিকার পেতে পারেন। ভোক্তা অধিকার আইনের ৪৪ ধারা অনুযায়ী, মিথ্যা ও অসত্য বিজ্ঞাপনের দ্বারা ক্রেতাকে প্রতারিত করা দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। একই সঙ্গে এই আইন অনুযায়ী, মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পণ্যসামগ্রী উৎপাদন ও বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিধান রয়েছে।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের বিশেষ কিছু অংশ

কোনো ব্যক্তি কোনো আইন বা বিধি দ্বারা কোনো পণ্য মোড়কাবদ্ধভাবে বিক্রয় করিবার এবং মোড়কের গায়ে সংশ্লিষ্ট পণ্যের সর্বোচ্চ খুচরা বিক্রয় মূল্য, উৎপাদনের তারিখ, প্যাকেটজাতকরণের তারিখ এবং মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করিবার বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করিয়া থাকিলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

যা বলা আছে এই আইনের ৩৭ ধারায়। গ্রাহক বা ভোক্তার দায়িত্ব সবকিছু দেখে পণ্য ক্রয় করা। সচেতনতা গ্রাহকের শক্তি। পণ্যের মূল্য ও সেবার মূল্যের তালিকা প্রদর্শন ও অধিকমূল্য গ্রহণ দণ্ডনীয়। ভেজাল ও নকল পণ্য উৎপাদন বিক্রয় শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। ওজনে কারচুপি, পরিমাপে কম দেয়া, ভুল বাটখাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ; যার শাস্তি এক বছর কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ড হতে পারে। মানুষের জীবন বা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকারক কোনো দ্রব্য কোনো খাদ্যপণ্যের সহিত যাহার মিশ্রণ কোনো আইন বা বিধির অধীন নিষিদ্ধ করা হইয়াছে, কোনো ব্যক্তি উক্তরূপ দ্রব্য কোনো খাদ্যপণ্যের সহিত মিশ্রিত করিলে তিনি অনূর্ধ্ব তিন বৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। তবে এর ফলে মৃত্যুবরণ করলে শাস্তির কোনো তারতম্য এই আইনে ব্যাখা করা হয়নি। সেবাগ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্নকারী কার্য করিবার ও অবহেলা ইত্যাদি দ্বারা সেবাগ্রহীতার অর্থ, স্বাস্থ্য, জীবনহানি ইত্যাদি ঘটালেও একই দণ্ডের বিধান রয়েছে।

প্রায়ই দেখা যায়, বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট ১৫ টাকার পানি ৩০ টাকা, ১৬ টাকার কোল্ড ড্রিংক্স ২০ টাকা রাখে। হাইওয়ে রেস্টুরেন্টগুলোতে আরও খারাপ অবস্থা। আমরা দিতেও বাধ্য হই। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ আইনবিরোধী। পচা-বাসি খাবার পরিবেশন করে অনেক হোটেলে, মানসম্মত বা মেয়াদোত্তীর্ণ জিনিসপত্র বা সেবার নামে হয়রানি করছে ভোক্তাদের অনেক প্রতিষ্ঠান। এ ধরনের অপরাধের কারণে আপনি ভোক্তা হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে অভিযোগ দিয়ে প্রতিকার পাবেন মাত্র ১৫ দিনের মাধ্যমে। তার জন্য আপনাকে সহজ কয়েকটি কাজ করতে হবে। কোনো ক্ষতিগ্রস্ত ভোক্তা, কোনো আইনের অধীন নিবন্ধিত কোনো ভোক্তা সংস্থা, সরকার বা সরকার কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অথবা সংশ্লিষ্ট পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী উক্ত অপরাধের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন। কারণ উদ্ভব হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে অভিযোগ দায়ের করতে হবে। তবে কোনো মিথ্যা বা হয়রানিমূলক মামলা করলে উল্টো আপনার শাস্তি হতে পারে।

অভিযোগ দায়েরের পদ্ধতি

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এর ধারা ৭৬ (১) অনুযায়ী, “যেকোনো ব্যক্তি, যিনি, সাধারণভাবে একজন ভোক্তা বা ভোক্তা হইতে পারেন, এই অধ্যাদেশের অধীন ভোক্তা-অধিকারবিরোধী কার্য সম্পর্কে মহাপরিচালক বা এতদুদ্দেশে মহাপরিচালকের নিকট ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে অবহিত করিয়া লিখিত অভিযোগ দায়ের করিতে পারিবেন।”

অভিযোগ দেয়ার জন্য আপনার প্রয়োজন হবে কিছু প্রমাণ। যে রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেবেন সেখানে খাবারের বিল বা সেবার জন্য ক্যাশ মেমো। যদি দৃশ্যমান জিনিস হয় তাহলে ছবি থাকলে তা আরও জোরালো প্রমাণ হিসেবে উপস্থিত করা যায় প্রয়োজনীয় সময়। প্রথমে dncrp.portal.gov.bd এই ঠিকানা হতে অভিযোগ দায়েরের জন্য ফর্মটি ডাউনলোড করে নিন। প্রিন্ট করে তাতে তথ্য ও বিবরণগুলো লিপিবদ্ধ করুন। ফর্মটি পূরণের পর তার একটি ছবি নিন অথবা স্ক্যান করুন যেন লেখা স্পষ্ট বোঝা যায়। বিলের কাগজটির একটি ছবি নিন মোবাইলে অথবা স্ক্যান করুন। অভিযোগ এবং বিল যদি ছবি থাকে পণ্যের বা বোতলটি বা জিনিসটির তাহলে তা সংযুক্ত করে ই-মেইল করুন- [email protected] এই ঠিকানায়।

অথবা
সরাসরি ডাকযোগে পাঠাতে পারবেন জাতীয় ভোক্তা অভিযোগ কেন্দ্র, টিসিবি ভবন (৯ম তলা), কারওয়ানৎবাজার, ঢাকা-১২১৫ ঠিকানায়।

অথবা
আপনার জেলার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালকের স্থানীয় অফিসেও অভিযোগ করতে পারবেন একই পদ্ধতিতে।

১৫ দিনের মধ্যে আপনার অভিযোগ বিষয়ে শুনানি করে তথ্য-প্রমাণ দেখে অভিযোগের সত্যতা পেলে শাস্তি প্রদান করা হবে। এই আইন মতে অভিযোগ প্রমাণ হলে জরিমানার টাকার ২৫ শতাংশ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত ভোক্তার হাতে তুলে দেয়া হয়।

তাই নিজের অধিকার বিষয়ে সচেতন হোন, আইন জানুন, কাজে লাগান, সচেতন থাকুন।

লেখক: অ্যাডভোকেট ও সদস্য
কনজুমার রাইটস অ্যাসোসিয়েশন, ময়মনসিংহ।

বিএ/এএ/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।