শহুরে বৃষ্টি কাব্যিক নয় ভোগান্তির


প্রকাশিত: ০৬:১৮ এএম, ২৪ এপ্রিল ২০১৭
ছবি : ইমরাত হোসেন রিমেন

রাজধানী ঢাকা শহরে মুষলধারে বৃষ্টি হলেই জনজীবনে নেমে আসে চরম ভোগান্তি। ফেসবুকে অনেকেই রসবোধের স্ট্যাটাস দিয়ে থাকেন হয়তো বাসায় বসে। কিন্তু রাজধানীর বাইরের চিত্রটা কিন্তু পুরোপুরি ভিন্ন। বৃষ্টি নামার আয়োজন দেখলেই অর্থাৎ নীল আকাশে মেঘের মিছিল শুরু হলে মুহূর্তেই বেড়ে যায় রিকশা ভাড়া। কর্মব্যস্ত এই শহরে কাজ শেষ করে রাস্তায় বের হয়ে যখন ১০-২০ টাকার ভাড়া রিকশাওয়ালা ৪০-৫০ টাকা (ক্ষেত্রবিশেষ তারও অধিক ভাড়া) দাবি করে তখন মেজাজ ধরে রাখা সত্যি অনেক কঠিন। এসব পরিস্থিতিতে বৃষ্টির কোনো রোমান্টিকতা কাউকে স্পর্শ করে না বরং চরম বিরক্তিকর মানসিকতা তৈরি হয়।

গণপরিবহনে উঠতে যাবেন, তাও পাবেন না। বৃষ্টি নামলে বাসগুলো কোথায় যেন হারিয়ে যায়। অন্যদিকে সড়কের জ্যাম এমন প্রকট আকার ধারন করে, কিছু কিছু সড়কে দীর্ঘ সময়ে যানবাহন চলাচল থেমে থাকে। গাড়ি না যায় সামনে, না যায় পেছনে। না পারবেন হেঁটে যেতে। সে এক বিটখিটে অস্বস্তিদায়ক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।

খেয়াল করে দেখবেন, রিকশাওয়ালা তুমুল বৃষ্টির সঙ্গে বাতাসের মধ্যে কাকভেজা হয়ে রিকশার প্যাডল মারছে আপনার গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। কিন্তু জীবিকার তাগিদে ওই রিকশাওয়ালার কোনো রাগ নেই, ক্ষোভ নেই, ক্লান্তি নেই। আপনার থেকে কিছু টাকা বেশি নেয়। তবে রোমান্সকর আবহাওয়ায় তার অনুভূতি বলার কেউ নেই। শত শত মানুষ তার পাশে, কিন্তু কোনো মানুষ তার নয়। লুঙ্গির ভাঁজে কয়েক প্যাঁচে গুজে রাখা মোবাইলটা বের করে, প্রিয়জনকে কল দেয়। ছেলেমেয়ে স্কুলে গিয়েছে কি না। গরুটাকে ঠিকমতো ঘাস দেওয়া হয়েছে কি না। হয়তো কাপা কাপা কর্কশ কণ্ঠে বউকে বলে, ‘ডাক্তার দেখাইও। বিকেলে টাকা পাঠায়ে দেবো। আজ অনেক টাকা মারছি।’

বিশ্বাস করুন, এই বৃষ্টি তাকে কোনো যৌন চাহিদায় মাতিয়ে তোলে না। তার মাথায় থাকে কিছু বাড়তি টাকা আয়ের চিন্তা। যার জন্য মুখোমুখি হতে হয় প্রতিনিয়ত খারাপ আচরণের। বাসে বসে থাকলে খেয়াল করবেন, ছোট ছেলেটি কিন্তু দরজায় দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করাচ্ছে। ওই হেলপার ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। বৃষ্টি তাকে কোনো আবেগে মাতায় না। ঝড় আসুক, বিদ্যুৎ চমকাক, ওই মানুষটি গেটে দাঁড়িয়ে স্টপেজে ঠিকমতো ওঠানামার কাজে সহযোগিতা করে যায়।

কাকভেজা সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা-রাত হেলপারের মধ্যে কোনো ভয়, আবেগ, দুঃখ, কষ্ট সৃষ্টি করে না। তার মাথায় থাকে যাত্রী ওঠানামা করানো। কারণ কম যাত্রী হলে মালিক তো বাজে ভাষা ব্যবহার করবে। ঠিকমতো হয়তো টাকাটা দিবে না। আর গরীব ওই হেলপারের সংসারে চাল কেনা হবে না। মলিন মুখে বাসায় ফিরে যাবে হাতে কয়েক কেজি চাল, আর হালকা বাজার নিয়ে। হয়তো তার যত্ন করার দিকে কারো খেয়াল নেই। সবার আব্দারের কথাটা শুনতে শুনতে ভোরবেলা বৃষ্টিতে জীবিকার প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হয়ে সারাদিন এই অবিরাম বৃষ্টিতে ভিজতে হয়।

বৃষ্টি যে শীতল মোহনীয় পরিবেশ তৈরি করে, কর্মজীবী মানুষটি তা স্পর্শ করতে পারে না। শহুরে জীবনের কঠিন বাস্তবতায় বিরামহীন বৃষ্টি বা কালবৈশাখী ঝড়ে এখন আর কবির কালিতে ছন্দ আসে না। গীতিকারের কথা আসে না। সুরকারের সুর আসে না। শহরজুড়ে নেমে আসে ভোগান্তির কালো মেঘ। অতিষ্ঠ করে তোলে জনজীবন। সঙ্গে সড়কে জমে যাওয়া নোংরা পানি, অপ্রত্যাশিতভাবে গায়ের পোষাক নষ্ট হয়ে যাওয়া, অফিসে যাওয়ার পথে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ভিজে যাওয়া সবই অস্বস্তিদায়ক।

শহরের দূষিত পানি গায়ে লেগে রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। বাচ্চারা নানারকম রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এছাড়া রোগিদের আনা-নেওয়ায় ভোগান্তি বাড়ে। গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করার উদ্দেশ্যে পরা পোশাকটি কিংবা চাকরির ভাইভাতে যাওয়ার পোশাকটি নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

সব মিলিয়ে বিরামহীন বৃষ্টি কোনো রোমান্টিসিজম নিয়ে আসে না। দুর্বিষহ করে তোলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। ফেসবুকের পাতায়- ‘উস্কানিমূলক আবহাওয়া, এমন দিনে তাহারে কাছে পেতে মনে চায়, উফ!’ কিংবা ‘অসহ্যকর রোমান্টিক আবহাওয়া’ লিখে অনেকেই স্ট্যাটাস দিয়ে থাকেন। অন্তত অবিরাম বৃষ্টি শহুরে জীবনে ওইরকম স্ট্যাটাস খেটে খাওয়া, দিনমজুর, মধ্যবিত্ত, নিম্ন আয়ের মানুষের সঙ্গে ঠাট্টা করা। সুতরাং টানা ভারি বর্ষণ শহুরে জীবনে কাব্য তৈরি করে না, জনজীবনে নেমে আসে চরম দুর্ভোগ।

লেখক : সংবাদকর্মী

এসইউ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।