বায়স্কোপের ১২১ বছর
দিনবদলের এই যুগে ‘কী চমৎকার দেখা গেল!’ কথাটি শোনা না গেলেও বাংলায় বায়স্কোপ পূর্ণ করছে ১২১ বছর। এমন এক সময় ছিলো যখন বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিলো যাত্রা-সার্কাস। কিন্তু সেই বিনোদনেও ছিলো সীমাবদ্ধতা। কেননা এই যাত্রা-সার্কাস ছিলো শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। কিন্তু সবার জন্য উন্মুক্ত ছিলো একটি লাল বাক্স। অনেকেই সেই লাল বাক্সকে জাদুর বাক্স নামে ডাকতো। যুগের সেই জাদুর বাক্সই আমাদের বায়স্কোপ।
পরিচিতি
একটি লাল বাক্স। মেলা, হাট কিংবা বিশেষ কোন দিনে গামছা মাথায় আর হাতে করতাল নিয়ে হাজির হতেন একজন মানুষ। আর সেই মানুষটিই হচ্ছেন জাদুর বাক্স- বায়স্কোপের কারিগর। প্রায় সব কারিগরেরই গলা ভাঙা হলেও সুরেলা আওয়াজ দিয়ে মূল জাদু ছড়াতেন তারা। এসব মিলিয়ে বায়স্কোপ।
লাল বাক্সের সামনের দিকে দুই পাশে চোঙার মতো কয়েকটি মুখ। প্রতিটি মুখেই উত্তল লেন্স লাগানো। আর বাক্সের ভেতর কাপড়ে লাগানো থাকে ছবি। কাপড়টা পেঁচানো থাকে পাশের দুটি কাঠিতে। কাঠির ওপরের মাথায় বাক্সের বাইরে লাগানো থাকে একটা হ্যান্ডেল। এই হ্যান্ডেল ঘোরালে ছবিসহ কাপড়টা একপাশ থেকে গিয়ে আরেক পাশে পেঁচাতে থাকে। তখন চোঙায় চোখ লাগিয়ে দেখা যায় ছবিগুলো। লেন্সের সুবাদে তখন সেই ছবিগুলো দেখায় বড় আর কাছে। ছবির সঙ্গেসঙ্গে করতাল বাজিয়ে সুরে সুরে দেয়া হয় ধারাবর্ণনা। এভাবে একবার বাঁ থেকে ডানে, ডান থেকে বাঁয়ে। এছাড়া প্রদর্শনীর পর মুড়ির টিনের মতো ঢাকনা দিয়ে আটকে রাখা হয় মুখ।
অভিধান মতে, বায়স্কোপ শব্দের অর্থ চলচ্চিত্র, ছায়াছবি, সিনেমা বলা হলেও আমাদের দেশে বায়স্কোপ নামে যা প্রচলিত তার যাত্রা শুরু হয়েছিল আধুনিক সিনেমা বা চলচ্চিত্রেরও বেশ আগে। বাংলায় বায়স্কোপকে প্রথমে টকি বা টগিও বলা হতো।
ইতিহাস
ইতিহাস মতে, স্টিফেন্স নামক এক বিদেশি বাংলায় প্রথম বায়স্কোপ দেখান। ১৮৯৬ সালে একটি থিয়েটার দলের সঙ্গে স্টিফেন্স কলকাতায় এসেছিলেন। আর তখনই তিনি কলকাতায় প্রথম দেখিয়ে যান বায়স্কোপ। তারপর তার অনুপ্রেরণায় মানিকগঞ্জের হীরালাল সেন দুই বছর পর ১৮৯৮ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিকভাবে বায়স্কোপ দেখানো শুরু করেন। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে।
কাহিনিতে বায়স্কোপ
‘কী চমৎকার দেখা গেল!’ কথাটি দিয়েই শুরু হতো জাদুর বাক্সের জাদু। ছবির মাধ্যমে একটি কাহিনি বর্ণনা করে গল্প বলাই ছিলো বায়স্কোপ ও তার কারিগরের কাজ। প্রথমে হাতে আঁকা ছবি ব্যবহার হতো। সাথে চলত জারিগানের সুরে সুরে ধারাবিবরণী, সঙ্গে করতালের তাল। কাহিনিতে আগে থাকত ক্ষুদিরামের ফাঁসি, বেদের মেয়ে জোছনা, মক্কা-মদিনা, আগ্রার তাজমহল, কারবালা-প্রান্তরের যুদ্ধ, তীরবিদ্ধ রক্তাক্ত দুলদুল ঘোড়া ইত্যাদি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন আসে ছবি ও কাহিনিতে। এরপর যোগ হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ইন্দিরা গান্ধী, জিয়াউর রহমান, সাদ্দাম-বুশের যুদ্ধ।
বায়স্কোপ থেকে সিনেমা হল
সিনেমা হলকে বায়স্কোপের উত্তরসূরি বলা হয়। কেননা ইতিহাস মতে, ছবি তোলার জন্য সেলুলয়েড ফিল্ম আবিষ্কারের পর চলমান বস্তু বা ব্যক্তির ছবি হুবহু তোলা সম্ভব হলো। আর তখন থেকে কতগুলো ছবি একটি ড্রামের ভেতর পর পর লাগিয়ে ড্রামটি ঘোরানো হতো আর ড্রামের একদিকে রাখা হতো দেখার ব্যবস্থা। এভাবেই বায়স্কোপের যাত্রা। তারপর ড্রাম থেকে আসে প্রজেক্টর আর পর্দা। তখন ছবিগুলোর স্থান হয় বাক্স থেকে রূপালি পর্দায়। এরপর নির্বাক ছবি একদিন সবাক হয়। সাদাকালোর যুগ পাঠ চুকিয়ে আসে রঙিন চলচ্চিত্র। সেদিক থেকেই সিনেমা হলো বায়স্কোপের উত্তরসূরি।
স্মৃতির পাতায় বায়স্কোপ
বায়স্কোপ এখন স্মৃতির পাতায়। দিনবদলের এই যুগে দর্শক খরায় ভুগেছে যুগের জাদুর বাক্স বায়স্কোপ। এখনো টুকটাক দর্শক আসে। তাও বিনোদনের জন্য নয়, ছোটরা আসে কৌতূহলে আর বড়রা স্মৃতির টানে। দর্শক খরার পরও রাজশাহীর বাঘমারা থানার চায়ের শারা গ্রাম থেকে প্রতিবছর মেলা উপলক্ষে গোটা উত্তরবঙ্গ বায়স্কোপ নিয়ে ঘোরেন আব্দুল জলিল। বায়স্কোপ নিয়ে অন্য কাউকে এখন আর দেখা যায় না আব্দুল জলিলের মত। আর তাতেই বোঝা যায়, এ ধারার শেষ যোদ্ধা তিনিই। বাংলায় বায়স্কোপ নিয়ে তৈরি হয়েছে গান ও সিনেমা। যেন স্মৃতির পাতায় বায়স্কোপকে উজ্জ্বল করতেই এই আয়োজন।
দিনবদলের এই যুগে হয়তো বায়স্কোপের স্থান হবে একদিন জাদুঘরে। জাদুর বাক্সের জাদু ছড়ানোর গল্প হয়তো আগামী প্রজন্মকে শুনতে হবে গল্প কিংবা সিনেমায়। কিন্তু জাদুর বাক্স যাদের কাছে জাদু ছড়িয়েছে তাদের কাছে আজীবন বেঁচে থাকুক স্মৃতির পাতায়।
এসইউ/আরআইপি