সাইকেলের ১৫০ বছর

মাহবুবর রহমান সুমন
মাহবুবর রহমান সুমন মাহবুবর রহমান সুমন , ফিচার কন্ট্রিবিউটর
প্রকাশিত: ০৮:০২ এএম, ০৫ ডিসেম্বর ২০১৬

তরুণ প্রজন্মের ফ্যাশন হিসেবে সাইকেল এখন জনপ্রিয় একটি বাহন। সাইকেলে নেই কোন দূষণ, নেই রাস্তায় বাড়তি জায়গা দখল করে রাখার ঝক্কি। বিনা খরচে দ্রুত পথচলা ও শারীরিক ব্যায়ামের ক্ষেত্রে সাইকেলের কোন বিকল্প নেই। তাই সাইকেল সব বয়সী মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয়।

সম্প্রতি দুই চাকার এই যানটির ১৫০ বছর পূর্ণ হলো। সাইকেলের এই সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে জেনে নিন সাইকেলের আদি-অন্ত।

পরিচিতি
সাইকেল ইংরেজি শব্দ, যার বাংলা অর্থ ‘দ্বিচক্রযান’। সম্ভবত দুই চাকার একটি গাড়ির এক অজ্ঞাত পরিচয় বর্ণনা করতে প্রথম ১৮৪৭ সালে ব্যবহৃত হয় একটি ফরাসি প্রকাশনায়। দুই চাকা বিশিষ্ট পায়ে চালানোর জন্য ব্যবহৃত বাহনকে সাইকেল বলা হয়। এতে সাধারণত কোনো মেশিন থাকে না, তবে আধুনিক কিছু বাইসাইকেলে মেশিন লক্ষ্য করা যায়।

cycle

প্রচলিত ইতিহাস
আজকের সাইকেলের অবয়বের সাথে আগের সাইকেলের অনেক পার্থক্য। অনেক কষ্ট ও পরিশ্রমের পর আমরা পেয়েছি এমন সুন্দর সাইকেল। ফরাসিদের দাবি, সাইকেল তাদের আবিষ্কার। এমনই একই দাবি জার্মান, স্কটিশ, ইংরেজদেরও। এমনকি অনেক সময় আমেরিকানরাও সাইকেল তাদেরই উদ্ভাবনী ক্ষমতার ফসল বলে দাবি করেন।

ইতিহাসে দেখা যায়, ঘোড়ার গাড়ি নির্মাতা ফরাসি দুই পিতা-পুত্র পিয়েরে ও আর্নস্ট মাইকক্স প্রথম বাইসাইকেল আবিষ্কার করেন ১৮৬০ সালে। কিন্তু আধুনিক ইতিহাসবিদরা দেখাচ্ছেন, সাইকেলের ইতিহাসটি তারও আগেকার। যদিও তারা এটা স্বীকার করেন যে, সেকেলের প্যাডেল ও ক্রাঙ্ক দুটি আর্নস্ট মাইকক্সেরই উদ্ভাবন, ১৮৬১ সালে।

তবে এমনও প্রচলিত আছে, ১৮১৭ সালে জার্মানির এক ব্যারন, নাম তার কার্ল ড্রাইজ ভন সয়্যারব্রন, তার বিশাল রাজকীয় বাগানের ভিতর দিয়ে দ্রুত গতিতে চলাচলের জন্য কাঠ দিয়ে তৈরি একটি মেশিন তৈরি করেন। এটির সামনে ও পিছনে দুটি সমানাকৃতির চাকা, যার সামনেরটা এদিক-ওদিক ঘোরানো যেতো এবং এটা সংযুক্ত ছিল উঁচু একটা ফ্রেমে যেটায় দুইপা ছড়িয়ে উঠে বসা যেত। সম্পূর্ণ কাঠ দিয়ে তৈরি যন্ত্রটা চলতো মাটিতে পা দিয়ে ধাক্কা দিলে। সে সময় এটা পরিচিত হয় ড্রাইসিয়েন বা হবি হর্স নামে। এটা অবশ্য খুব বেশি দিন টেকেনি কারণ বাস্তবসম্মত বাহন হিসেবে এটা খুব দক্ষ কিছু ছিল না।

cycle

অন্য ইতিহাস মতে, ১৮১৬ সালে সর্বপ্রথম জার্মানিতে সাইকেলের উদ্ভব হয়। সে সময় সাইকেলের কোনো প্যাডেল, গিয়ার, টায়ার, চেইন ইত্যাদি যন্ত্রাংশ ছিল না। সর্বপ্রথম সাইকেল উদ্ভাবক কার্ল ভন ডেভিস ১৮১৮ সালে সর্বপ্রথম তার তৈরিকৃত সাইকেল প্যারিসে জনসম্মুখে নিয়ে আসেন। প্যাডেলহীন এই সাইকেলেরে সিটে বসে মাটিতে পা লাগিয়ে ঠেলে ঠেলে চালাতে হতো। এজন্য ইংল্যান্ডে ব্যঙ্গ করে সাইকেলকে বলা হতো ‘ডান্ডি হর্স’ বা শৌখিন বাহন। সর্বপ্রথম এই সাইকেলের চাকা ছিল তিনটি। এরপর ১৮৬০ সালে প্যাডেল জুড়ে দেয়া হয় সাইকেলে। তবে চাকার সংখ্যা তিন থেকে কমিয়ে একে নিয়ে আসা হয়। ফলে নতুন সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় যে, এই সাইকেল সবাই চালাতে পারতো না। যারা চালাতে পারতো তাদেরকে সম্মানের চোখে দেখা হতো এবং তাদের অনেক কৃতিত্বপূর্ণ লোক বলে মনে করা হতো। এক চাকার এই সাইকেলগুলোকে ইউনি সাইকেল বলা হতো। তখন সার্কাসের শো গুলোতে এই সাইকেল ব্যবহার করা হতো। আজও বিশ্বব্যাপী সার্কাস শোতে এই সাইকেল ব্যবহার করা হয়। ১৮৬১ সালে প্যাডেল লাগানো হলেও সেটিতে চেইন লাগানো ছিল না। প্যাডেল ছিল সামনের চাকায়। আর এর চাকা ছিল লোহার তৈরি, ফলে রাস্তায় চলার সময় ঝনঝন শব্দ হতো। সাইকেলের এই ঝনঝনানি শব্দের কারণে তখন এটির নাম দেয়া হয় ‘বান শেকার’। এর বছর দশেক পরে বাজারে আসে এরিয়েল নামের নতুন এক ধরনের সাইকেল। যে সাইকেলেরও প্যাডেল ছিল সামনের চাকায় এবং এর সামনের চাকা ছিল পিছনের চাকার চেয়ে অনেক বড়।

এরপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকমের সাইকেল তৈরি হতে থাকে। কারো সামনের চাকা বড়, কারো পিছনের চাকা বড়, কারো বসার জায়গা নিচে আবার কারো বসার জায়গা অনেক উপরে। বিভিন্ন ধরনের সাইকেল আবিষ্কার হলেও সাইকেলগুলো চালানো সহজ হচ্ছিল না। ওই সময় কিছু কিছু সাইকেলের চাকা ২০ ফুট পর্যন্ত উঁচু ছিল। ১৮৮০ সালে সর্বপ্রথম সাইকেলের দুই চাকা সমান পর্যায়ে নিয়ে আসা হয় এবং চেইন ও টায়ার লাগানো হয়। তবে টায়ারে হাওয়া ভরা থাকতো না। মেয়েরা যাতে স্কার্ট পরে সাইকেল চালাতে পারে সেজন্য এই সময় তৈরি করা হয় ভিন্ন এক ধরনের সাইকেল। ১৮৮৮ সালে টায়ারে সর্বপ্রথম হাওয়া ঢুকানোর ব্যবস্থা করা হয়। এর মাধ্যমে সাইকেলের আধুনিক যুগের সূচনা হয়।

cycle

স্বীকৃত ইতিহাস
সাইকেল তৈরির স্বীকৃত ইতিহাস হল, ফ্রান্সের পিয়ের মিশো এবং যুক্তরাষ্ট্রের পিয়ের লালেমেন্ট- এই দু’জন প্রথম প্যাডেল চালিত সাইকেল আবিষ্কার করেন। তবে দু’জনের কে আসল উদ্ভাবক তা কিন্তু আজও সঠিকভাবে জানা যায়নি। যদিও ১৮৬৬ সালের ২০ নভেম্বর পিয়ের লালেমেন্ট সাইকেল উদ্ভাবনের জন্য তাঁর দেশে স্বীকৃতি লাভ করেন। আর সেই হিসেবেই সম্প্রতি দুই চাকার এই যানটির সার্ধশত জন্মবার্ষিকী। অন্যদিকে ১৮৭০ সালের পরে ব্রিটেনে আরো দ্রুত, সুন্দর এবং উঁচু সাইকেল তৈরি করেন জেমনস স্টার্লি ও উইলিয়াম হিলম্যান। তবে সেগুলোর মান তেমন উন্নত না হওয়ায়, সে সময় কিছু গুরুতর দুর্ঘটনা ঘটে। যে কারণে পরে আর এগুলোকে রাস্তায় চলতে দেখা হয়নি। তবে ১৮৮৮ সালে সাইকেলে নিডাররাড ও ডানলপ কোম্পানির চাকা লাগানোর ফলে দুই চাকার বাহনের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে।

cycle

অন্যদিকে ১৯৯৬ সালে সাইকেল অলিম্পিক প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে মোট ৮৮জন প্রতিযোগী। সাইকেল অলিম্পিক প্রথম অনুষ্ঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাটলান্টার কাছে, জর্জিয়া আন্তর্জাতিক হর্স পার্কে। তবে ১৯০৩ সালের ০১ জুলাই থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত প্রথমারের মতো ফ্রান্সে ট্যুর দ্য ফ্রঁস শুরু হয়। আর ছয় রাউন্ডের এই প্রতিযোগিতায় মোট ২৪২৮ কিলোমিটার সাইকেল চলান প্রতিযোগীরা। ট্যুর দ্য ফ্রঁস-এর প্রথম বিজয়ী হন ফরাসি চালক মরিস গাঁরা।

সাইকেলের ধরন
সাইকেল মোটামুটি সাত ধরনের হতে পারে। ট্যুরিং, মাউন্টেইন, হাইব্রিড বা ক্রস, ইউটিলিটি, রেসিং বা স্পেশিয়ালিটি, দু’টো সিটের এই সাত টাইপ দিয়েই সাইকেল চেনা যায় এ যুগে। সহজ সরল বাধানো রাস্তায় চলার জন্য ব্যবহার করা হয় ট্যুরিং বাইসাইকেল। পাহাড়ি ঢালু এবং এবড়োখেবড়ো পথে চলতে ব্যবহৃত হয় মাউন্টেইন বাইক। আর এই দুই ধরনের অর্থাৎ ট্যুরিং ও মাউন্টেইন সাইকেলের সম্মিলিত প্রযুক্তি ও সুবিধা নিয়ে যে সব সাইকেল পাওয়া যায় সেগুলো হাইব্রিড বা ক্রস বাইসাইকেল। চৌদ্দ কেজির বেশি ওজন আর দামে সস্তা ইউটিলিটি বাইসাইকেল ব্যবহৃত হয় মূলত মালামাল পরিবহনের জন্য, ছোটরাও এগুলো চালায়। সবচেয়ে হালকা সাইকেল হিসেবে সুনাম আছে রেসিং বাইসাইকেলের। বাতাস কেটে দ্রুত গতিতে চালানোর জন্য এগুলোকে হালকা করে তৈরি করা হয়। বিশেষ প্রয়োজন মেটানোর জন্য অন্য যেকোনো ডিজাইনের সাইকেলকেই স্পেশালিটি সাইকেল বলে। এর একটি উদাহরণ হতে পারে ইলেকট্রিক সাইকেল। এর মধ্যে থাকে ব্যাটারি আর ছোট্ট ইলেকট্রিক মোটর থাকে ব্যাক হুইলে। মোটরটা একা পুরো সাইকেলকে চালানোর মতো শক্তিশালী নয়, এর জন্য সাইকেল চালকেরও দরকার আছে। অন্যদিকে রয়েছে দু’টো সিটের সাইকেল। তবে যিনি সাইকেল চালান অর্থাৎ প্রথম সিটের চালককে বলা হয় পাইলট বা ক্যাপ্টেন। টানডেমে পেছনের সিটের সঙ্গীর পাইলটকে সঙ্গ দেওয়া ছাড়া তেমন কিছু করার থাকে না।

cycle

উপকারিতা
অল্প খরচ বা বিনা খরচে দ্রুত পথ চলা বা মালামাল পরিবহনের জন্য সাইকেল বেশ জনপ্রিয়। এছাড়া সাইকেলে নাই কোন দূষণ, নাই বাড়তি জায়গার চাহিদা। শারীরিক ব্যায়ামের ক্ষেত্রে সাইকেলের নেই কোনো বিকল্প। তাছাড়া ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে সাইকেলের কোনো জুড়ি নেই। নিয়মিত সাইকেল চালালে আছে স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন উপকারিতা।

সতর্কতা
নতুন সাইকেল চালানো শেখার সময় বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। যাতে পড়ে গিয়ে বেশি আঘাত না পায়। এছাড়া নিয়মিত সাইকেল চালানোর জন্য হেলমেটসহ অন্য প্রয়োজনীয় বস্তু পরিধান করে নিতে হবে। যাতে অসাবধানতাবশত দুর্ঘটনা ঘটলে আঘাত কম লাগে। তাছাড়া অকারণে বন্ধুদের সাথে রেসিংয়ে অংশ নেয়া সমীচীন নয়।

এসইউ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।