গ্রামবাংলায় হেমন্তের রূপবৈচিত্র্য

মো. সাঈদ মাহাদী সেকেন্দার
মো. সাঈদ মাহাদী সেকেন্দার মো. সাঈদ মাহাদী সেকেন্দার , লেখক
প্রকাশিত: ১০:৪৬ এএম, ১৬ অক্টোবর ২০১৬

বাংলাদেশের বিচিত্র ছয়টি ঋতু প্রকৃতিতে ভিন্নতা আনে। পাশাপাশি বাংলা সংস্কৃতিকেও প্রভাবিত করে থাকে। এ ছয়টি ঋতুর মধ্যে হেমন্ত ঋতু এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে।

হেমন্ত ষড়ঋতুর চতুর্থ ঋতু। যা কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসের সমন্বয়ে গঠিত। শরতের পর এই ঋতুর আগমন। হেমন্তের পরে আসে শীত। তাই হেমন্তকে বলা হয় শীতের পূর্বাভাস।

‘কৃত্তিকা’ ও ‘আর্দ্রা’ এ দুটি তারার নামানুসারে নাম রাখা হয়েছে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসের। ‘মরা’ কার্তিকের পর আসে সর্বজনীন লৌকিক উৎসব নবান্ন। ‘অগ্র’ ও ‘হায়ণ’ এ দু’অংশের অর্থ যথাক্রমে ‘ধান’ ও ‘কাটার মওসুম’। সম্রাট আকবর অগ্রহায়ণ মাসকেই বছরের প্রথম মাস বা খাজনা আদায়ের মাস ঘোষণা দিয়েছিলেন।

এক সময় বাংলায় বছর শুরু হতো হেমন্ত দিয়ে। কারণ ধান উৎপাদনের ঋতু এই হেমন্ত। বর্ষার শেষদিকে বোনা আমন-আউশ শরতে বেড়ে ওঠে। আর হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিকে ধান পরিপক্ক হয়। হেমন্তের ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই নবান্ন উৎসবের সূচনা হয়। নবান্ন (নতুন অন্ন) পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শস্যোৎসব। নবান্ন হল নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব। যা সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর অনুষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে ফসল তোলার পরদিনই নতুন ধানের চালে ফিরনি-পায়েশ অথবা ক্ষীর তৈরি করে আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর ঘরে ঘরে বিতরণ করা হয়। নবান্নে জামাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়, মেয়েকেও বাপের বাড়িতে ‘নাইওর’ আনা হয়।

নবান্নে বিভিন্ন ধরনের দেশীয় নৃত্য, গান, বাজনাসহ আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক কর্মসূচি পালিত হয়। এছাড়া লাঠিখেলা, বাউলগান, নাগরদোলা, বাঁশি, শখের চুড়ি, খৈ ও মোয়ার পসরা বসে গ্রাম্য মেলায়।

এ ঋতুতে ফোটে গন্ধরাজ, মল্লিকা, শিউলি, কামিনী, হিমঝুরি, দেবকাঞ্চন ও রাজ অশোক প্রভৃতি। নবান্ন অথবা হেমন্ত ঋতুর শান্ত প্রকৃতি অনেক কবি-সাহিত্যিকের রচনায় ধরা পড়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সুফিয়া কামাল, জসীমউদদীন, জীবনানন্দ দাশ ও গোলাম মুস্তফা প্রমুখ। কাজী নজরুল ইসলামের ‘অঘ্রাণের সওগাত’ কবিতায় নবান্নের চিত্রটি বেশ উপভোগ্য। বিশ্বকবি তাঁর কবিতায় বলেছেন-
‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে
জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে
শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার
রয়েছে পড়িয়া শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার
স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি।’

বাংলা কবিতা পথ পরিক্রমায় একেক দশকে একেক চরিত্র নিয়ে অগ্রসর হলেও স্বদেশের রূপ-বৈচিত্র্য রূপায়ণে অনড়। আর এই কাজে কবিদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে এ দেশের ঋতুবৈচিত্র্য। জীবনানন্দ দাশের কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ হেমন্ত।
হেমন্তের সোনালি ধান আর তার শিশির বিন্দু আমাদের প্রকৃতির এক অপরূপ দৃশ্য।

হেমন্ত ঋতু হিসেবে যেমন সমৃদ্ধ; তেমন সমৃদ্ধ করে আমাদের প্রকৃতি। হেমন্ত তার রূপবৈচিত্র্য নিয়ে ফিরে ফিরে আসুক বাংলায়, চিরন্তন মাধুর্য নিয়ে আসুক যুগে যুগে।

লেখক: শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

এসইউ/এবিএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।