পাতায় কেনা এক টুকরো শৈশব

সাজেদুর আবেদীন শান্ত
সাজেদুর আবেদীন শান্ত সাজেদুর আবেদীন শান্ত , ফিচার লেখক
প্রকাশিত: ১১:৪৪ এএম, ০৮ এপ্রিল ২০২৫

দুপুর গড়িয়েছে। আকাশজুড়ে রোদ। আমি আর সাংবাদিক আব্দুর রাজ্জাক ভাই পেছনে ফেলে আসা খবরের খোঁজে, এগিয়ে চলেছি মোটরসাইকেলে হাওয়ার গায়ে ভর করে। পথ বগুড়ার সোনাতলার তেকানী চুকাই নগর ইউনিয়নের এক প্রত্যন্ত চর।

চারদিক নিস্তব্ধ, কেবল বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে চরবাসীর জীবনসংগ্রামের গন্ধ। হঠাৎ এক মুহূর্তে চোখ আটকে গেল এক আশ্চর্য দৃশ্যে-গাছের ছায়ায় পলিথিন আর পুরনো বস্তা দিয়ে তৈরি এক দোকান! দোকানের কাঠামো দেখে প্রথমে মনে হলো, হয়তো কারও রেখে যাওয়া কিছু। কিন্তু না, একটু কাছে যেতেই বোঝা গেলো এটা শিশুদের নিজস্ব তৈরি এক খেলনা দোকান।

বিজ্ঞাপন

দোকানের মালিক এক রোদে পোড়া শিশু। বয়স হয়তো আট অথবা নয় বছর। গায়ে শুধু হালকা রঙের হাফপ্যান্ট। পাশেই আরেকটা শিশু পড়নেও টিয়া কালারের হাফপ্যান্ট। আর দোকানের সামনে ঝোলানো পলিথিনের ব্যাগে সাজানো নানান কিছু। বিভিন্ন গাছ গাছালির লতাপাতা দিয়ে তৈরি উপাদান, পাতার প্যাকেট, আর ছোটছোট মাটির পাত্রের মতো কী যেন।

পাতায় কিনে এক টুকরো শৈশব

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

কাছে গিয়ে জিজ্ঞাস করলাম, বাবু এইটা কিসের দোকান? তারা জবাব দেয় না, শুধু হাসে। আবারও জিজ্ঞাস করতেই পাশে থাকা সেই শিশুটি উত্তর দিলো এইটা খেলনা দোকান। এই দোকানে টাকায় কিছু কেনা যায় না। এখানে কিছু কিনতে হলে ‘কাঁঠাল পাতা’ দিয়ে কিনতে হয়।

বুঝলাম গাছের পাতা দিয়েই চলে লেনদেন। কথা বলতেই দল বেঁধে আরও তিন জন শিশু আসলো। তারা প্রতীকী অর্থে হাতে পাতা নিয়ে কেউ ‘মরিচ’ কিনছে, কেউবা শুঁটকি। কারও মুখে হাসি, কারও চোখে আগ্রহ। দোকানদার ছোট্ট হাত বাড়িয়ে পণ্য দিচ্ছে, বিনিময়ে নিচ্ছে কাঁঠাল পাতা; একটি, দুটি, কখনো তিনটি পাতার বিনিময়ে দিচ্ছে একেকটি ‘পণ্য’।

আরও কিছু শিশু এসে দাঁড়ালো দোকানের সামনে। দোকানদার ছেলেটা মাঝে মাঝে বলছে ‘এইটা তিনপাতা, ওইটা একপাতা!’ যেন সে পুরো একটা বাজারের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

আমি পকেট থেকে মোবাইল বের করে কিছু স্মৃতি জমাইতে চাইলাম। তারাও খুব আগ্রহী হয়ে ক্যামেরার দিকে তাকাচ্ছে। বেশ কিছু ছবি তোলার পর, আমারও কিছু কেনার শখ হলো। এরপর আশপাশের কয়েকটি কাঁঠাল পাতা কুড়িয়ে এনে আমিও কিনলাম তাদের স্বপ্নের কিছু জিনিস।

এই দোকানে নেই কোনো লাভের হিসাব, নেই কোনো প্রতিযোগিতা। আছে বন্ধুত্ব, আনন্দ, আর সৃষ্টির নেশা।

এরপর ফিরে গেলাম আমাদের কাজে। আর চোখের সামনে সেই স্মৃতি রোমাঞ্চ করতে লাগলাম। আমরা যারা শহরে বড় হয়েছি, আমাদের শৈশবের চা-দোকান, বালুর মাঠের বাজার, আমপাতা-কাঁঠাল পাতা দিয়ে কেনাবেচা, কলা গাছের ঢোঙলা দিয়ে নৌকা, ফানেল দিয়ে মাইক-সব কেমন যেন হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। চোখেই যেন পড়ে না আর। কিন্তু এই শিশুরা আবারও সেই স্মৃতি মনে করে দিলো। এই চরাঞ্চলের শিশুরা এখনো সেই কল্পনার পৃথিবী বাঁচিয়ে রেখেছে। তারা জানে না ‘ইমাজিনেটিভ প্লে’ বা ‘রোল প্লে’ কী-তারা শুধু জানে আনন্দ খুঁজে নিতে হয় নিজের মতো করে।

বিজ্ঞাপন

জেএস/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।