চাকরি ছেড়ে সফল উদ্যোক্তা সাইফুল, মাসে আয় ৫ লাখ

মোহাম্মদ সোহেল রানা
সাইফুল ইসলাম পাঠান, বয়স ৩৭। দীর্ঘ ১৩ বছর চাকরি করেছেন দেশের নামি-দামি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু স্বাধীনচেতা এই তরুণ থেমে থাকেনি প্রাতিষ্ঠানিক চাকরিতে। স্বপ্ন ছিল উদ্যোক্তা হবেন। এরপর স্বপ্ন পূরণে দেড় লাখ টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে দেন। নিজেই গড়ে তোলেন ‘পাঠান এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি সেলস ও মার্কেটিং ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। বিদেশ থেকে স্পিনিং মিলের সুতা আমদানি করে দেশের বিভিন্ন পোশাক তৈরির কারখানায় সরবরাহ করেন। নিজে সফল উদ্যোক্তা হওয়ার পাশাপাশি বেশ কয়েকজনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করেছেন এই তরুণ।
সম্প্রতি সাইফুল ইসলাম পাঠান তার সফলতার গল্প ও কীভাবে উদ্যোক্তা হওয়ার আশা জাগলো এসব বিষয় নিয়ে জাগোনিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মোহাম্মদ সোহেল রানা-
চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা হওয়া মোটেও সহজ নয়। চাকরির নিরাপত্তা, নির্দিষ্ট আয় এবং প্রতিষ্ঠিত ক্যারিয়ার ছেড়ে অনিশ্চিত পথে পা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত সবার জন্যই সুখময় হয় না। তবে কিছু মানুষ আছেন, যারা নিজের স্বপ্নের পেছনে দৌঁড়াতে ও ঝুঁকি নিতে পছন্দ করেন। তাদের মধ্যেই একজন সাইফুল ইসলাম পাঠান। কঠিন পরিশ্রম ও ত্যাগের মাধ্যমে হয়েছেন একজন সফল উদ্যোক্তা। একই সঙ্গে তিনি তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার সাহসও জাগিয়েছেন।
জাগোনিউজ: কর্মজীবনে যাত্রা কীভাবে শুরু?
সাইফুল ইসলাম: ২০১১ সালে বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স) থেকে স্নাতক সম্পন্ন করার পরেই কর্মজীবনে পা রাখি। যেখানে ভিয়েলাটেক্স এবং রেনেসাঁ গ্রুপে চাকরি করেছি। তবে রেনেসাঁ গ্রুপেই সাত বছর যুক্ত ছিলেন। সেখানে মূল কাজ ছিল বায়ারদের সঙ্গে গার্মেন্টসের পোশাক ও সুতা নিয়ে আলোচনা করে অর্ডার নেওয়া। একজন মার্কেটার হিসেবে যেসব কাজ করে অর্ডার নেওয়া যায়, দীর্ঘ এ কর্মজীবনে মেধা ও টেকনিক ব্যবহার করে তাই করছি।
জাগোনিউজ: কখন থেকে উদ্যোক্তা মনোভাব শুরু?
সাইফুল ইসলাম: কর্মজীবনের একদম শুরুতেই উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ব্যবসা শুরু করি। তবে সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে ব্যবসায় বড় একটা ধরা খাই। পরে চাকরিতে মনোনিবেশ করি। কর্মজীবনে গার্মেন্টস মার্কেটিংয়ের মার্চেন্ডাইজার ও ম্যানেজার ছিলাম। তবে ২০২০ সালে করোনাভাইরাস শুরু হওয়ার পর সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশের অবস্থাও ভয়াবহ হয়। যার ফলে দেশজুড়ে লকডাউন দেয় সরকার। সেই সময় বাসা থেকে অফিস করা হতো। তখনি চাকরির পাশাপাশি কিছু একটা করার চিন্তা আসে।
অন্যদিকে ছোটকাল থেকেই আমার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের অন্য রকম দক্ষতা ছিল। বন্ধুদের পড়াশোনাসহ যে কোনো বিষয়ে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া, অন্যদেরও যে কোনো ভালো তথ্য শেয়ার করাসহ বিশেষ গুণাবলি ছিল। তাই ভাবতে থাকি এসব গুণাবলি কাজে লাগিয়ে নতুন কিছু করবো। সব সময়ে বাসার থাকার কারণে অফিসের কাজের পাশাপাশি মার্কেটিং নিয়ে ট্রেনিং শুরু করি। এছাড়া বিশ্বের বড় বড় ব্যবসায়ীদের জীবনী পড়ি। কীভাবে তারা ব্যবসা শুরু করেছিলেন এবং বর্তমানে কোন অবস্থানে আছেন জানার চেষ্টা করি। এভাবে এসব নিয়ে পড়াশোনা আরও বাড়তে থাকে। এতে ব্যবসা নিয়ে নানা ধরনের ধারণা পেতে থাকি। এতেই বিশ্বাস জন্ম নেয় এসব জ্ঞান কাজে লাগিয়ে পরিশ্রম করতে পারলে সফল হবো।
জাগোনিউজ: ব্যবসার জন্য চাকরি কেন ছাড়লেন?
সাইফুল ইসলাম: চাকরিতে অনেক বেস্ট পারফর্ম করতে ছিলাম, ম্যানেজমেন্ট খুশি, আমার টিম ছিল বড়, নিজেও কাজের ওপর খুশি ছিলাম। তবে খেয়াল করলাম, বছর শেষে বেতন বাড়লেও তেমন একটা বাড়ে না। দেশের যে পরিস্থিতি সব কিছুর দাম বাড়তি। এর মাঝে পরিবার নিয়ে চলা দিন দিন কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এতে নিজেও তেমন উন্নতি করতে পারবো না, আর্থিক সমস্যা লেগেই থাকবে। তাই নিজেকে মেলে ধরতে এবং নতুন কিছু করতে ব্যবসা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো বিকল্প নাই। এছাড়া করোনার সময় ২ মাসের বেতন কাটার বিষয়টা আমাকে বেশি কষ্ট দিসে। সব মিলিয়ে মনস্থির করলাম ব্যবসা করবো। এক পর্যায়ে চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেই। পরে ২০২২ সালের আগস্ট মাসে চাকরি ছেড়ে দেই।
জাগোনিউজ: চাকরি ছেড়ে ব্যবসার যাত্রা কেমন ছিল?
সাইফুল ইসলাম: আমি যে সময়ে চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এর ঠিক এক মাস পর স্ত্রীর (প্রথম সন্তান) ডেলিভারি ডেট, তাই পরিবারের সদস্যরা বলতেছিল তুমি কেমন বাবা, এমন সময়ে চাকরি ছাড়তে চাও। বাচ্চা হওয়ার ছয় মাস পর ছাড়ো তবে আমি কোনো কথা না শুনে চাকরি ছেড়ে দেই। ডেলিভারির সময় তেমন টাকা সঞ্চয় ছিল না, আগেই বলেছি বেতন বাড়লেও জমা করতে পারতাম না। চাকরি ছাড়ার সময় অফিস থেকে আড়াই লাখ টাকা দেয়। সেখান থেকে এক লাখ টাকা স্ত্রীর হাসপাতালে খরচ হয়। আর বাকি টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করি।
ব্যবসার পুঁজি কম থাকার কারণে বাড়িওয়ালার সঙ্গে চুক্তি করি মাসে মাসে ভাড়া না দিয়ে কয়েক মাস পর পর একসঙ্গে দিব। এমন প্রস্তাবে প্রথম রাজি না হলেও রিকোয়েস্ট করায় পরে রাজি হয়। এছাড়া সংসারের বাজারের জন্য স্ত্রীকে যে টাকা দিতাম মাস শেষ সেখান থেকেও নিয়ে হাত খরচ চালাইতাম। নিজের একটা মোটরসাইকেল ছিল তাও বিক্রি করে দেই। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা ও ঘুরাঘুরিও কমিয়ে দেই, ভালো জামা কাপড় কিনতাম না। প্রয়োজনের বাইরে টাকাও খরচ করতাম না। শুধু তাই নয় মার্কেটিংয়ের জন্য এক অফিস থেকে আরেক অফিসে যেতে রিকশায় চলাচল না করে বেশিরভাগ সময় হেঁটে গেছি। রোদ বৃষ্টি কোনো কিছুর তোয়াক্কা করিনি, একটা বছর শুধু মার্কেটিং করেই গেছি। অনেক কষ্ট হয়েছে তবুও হাল ছাড়িনি। আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে পরিশ্রম করে গেছি, তিনি পরিশ্রমকারীদের কখনো ব্যর্থ করেন না। আমার বিশ্বাস ছিল একদিন সফল হবো।
জাগোনিউজ: আপনার মতে কেন উদ্যোক্তা হওয়া জরুরি?
সাইফুল ইসলাম: চাকরিতে প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা যে কাজ করি তা একটা লিমিটেড। তবে ব্যবসাতে নিজে মতো সময় দিতে পারবেন। চাকরিতে বেতন একটা নির্ধারিত থাকে আর বছর শেষে বাড়লেও প্রয়োজনের তুলনায় কম। কিন্তু ব্যবসাতে আপনি যত পরিশ্রম করবেন ততই আয় বাড়বে। সব দিকেই আপনি উন্নতি করতে পারবেন। চাকরিতে আপনার দক্ষতা নিজের মতো করে চাইলেই খাটাতে পারবেন না। আর কঠিন পরিশ্রম করে কোম্পানির জন্য ভালো কিছু করলেও আপনি সেই ক্রেডিট পাবেন না। কোম্পানিতে কিছু সংখ্যক বস থাকে যারা আপনার কাজের ফল ভোগ করবে। কোনো ক্রেডিট আসার পর তারাই মালিককে বলবে আমি পরিশ্রম করছি, আমার দিকনির্দেশনায় এই অর্জন। দিন শেষে আপনার বেতন আর বাড়বে না, পরিশ্রম শূন্য। আর ক্রেডিট দিলেও তা পরিমাণের তুলনায় কম।
আমার মতে বর্তমানে চাকরি আসলে এক ধরনের জেলখানা যেখানে কোম্পানির বসরা সব সময় আপনাকে মানসিক চাপেই রাখবে। তারা একা সুবিধা ও ক্রেডিট ভোগ করেই চলবে। এখানেই শেষ নয় পরিবারের কোনো সদস্য বা আত্মীয়-স্বজন কেউ অসুস্থ হলে বা বিশেষ প্রয়োজনে ছুটি নিতে গেলে বসরা নানান বাহানা জুড়ে দেন। অনেক বসরা কর্মীদের বিপদ সমস্যা বুঝতেই চান না। তারা ২৪ ঘণ্টায় কর্মীদের আলাদা একটা প্যারা দিয়েই থাকে। এতে অনেক কর্মী ধীরে ধীরে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক কথায় আপনার স্বাধীনতাই কেড়ে নেয়।
এদিকে নিশ্চিত বেতনের চাকরি ছেড়ে একটা অনিশ্চিত পথে পা বাড়ানো মোটেও সহজ নয়। খেয়ে না পড়ে রাস্তাঘাটে ঘুরে রোদে-বৃষ্টিতে কষ্ট করে একটা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানো মোটেও সহজ নয়। শুধু তাই নয় ব্যবসাতে ঝুঁকি নিতে হবে। লাভ বা ক্ষতি দুটোই হতে পারে। প্রথমেই সফল হবেন এমন ধারণা ঠিক নয়। অর্থের পুঁজির পাশাপাশি ব্যবসায়িক ধারণাও থাকতে হবে। সঠিক গাইডলাইন মেনে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে হবে। দ্রুত সফলতা পাওয়া সম্ভব নয়।
আপনি যে ধরনের পণ্য নিয়ে ব্যবসা করবেন তার ওপর পড়াশোনা করতে হবে এবং অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীদের থেকে পরার্মশ নিতে হবে। এরপরেই মাঠে নামলে আপনার জন্য ভালো। কোনো কারণে ক্ষতি হলেও অনেকটা কম হবে। সব মিলিয়ে ব্যবসার জন্য আর্থিক সামর্থ্য, সুযোগ এবং পরিশ্রম করতে পারলে বসে না থেকে আমার মতে তরুণদের জন্য ব্যবসায় উত্তম। কারণ তরুণরা কঠিন পরিশ্রম ও ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।
জাগোনিউজ: আপনার ব্যবসার ধরণ ও বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে জানাবেন।
সাইফুল ইসলাম: বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে স্পিনিং মিলের সুতা বাংলাদেশে এনে বিভিন্ন পোশাক কারখানা সরববাহ করি। এর মধ্যে চায়না ও ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি সুতা আমদানি করা হয়। এ কাজে আমার সঙ্গে আরও বেশ কয়েকজন যুক্ত রয়েছেন। এ কাজের মাধ্যমে আমি আলাদা একটা কমিশন পাই। এতে সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতি মাসে আমার ৫ লাখের বেশি টাকা আয় থাকে। যা দিয়ে বর্তমানে ভালোভাবেই চলতে পারছি।
জাগোনিউজ: ব্যবসা নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?
সাইফুল ইসলাম: ব্যবসা শুরু করার অল্প সময়ের মধ্যেই সফলতা পেয়েছি। এখন এ সফলতার ধারা ধরে রাখতে চাই। একই সঙ্গে ব্যবসার পরিধি কীভাবে বাড়ানো যায় তা নিয়ে ভাবছি। যেখানে দেশের বা বিদেশের কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আমার ব্যবসাতে বিনিয়োগ করতে পারবে। এছাড়া বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানেরও করতে পারি সেই চেষ্টা করছি।
কেএসকে/জিকেএস