চাঁদপুরের ৪০০ বছরের বাখরপুর জামে মসজিদ

চাঁদপুর সদর উপজেলার বাখরপুর গ্রামে রয়েছে প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যের ধারক বাখরপুর জামে মসজিদ। স্থানীয়ভাবে এটি গায়েবি মসজিদ নামে পরিচিত।
জানা যায়, নৌ যোগাযোগ সহজ হওয়ার কারণে এ জেলায় ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য ভারতীয় মুসলমানদের আগমন ঘটে। তারা অস্থায়ীভাবে এই জেলায় অবস্থান করলেও বিভিন্ন সময় নানা স্থাপনা তৈরি করে যায়। ওইসব স্থাপনারই অংশ চাঁদপুরের বিভিন্ন এলাকায় চুন-সুরকি দিয়ে তৈরি করা মসজিদ। এসব স্থাপনাগুলো মুগল আমলের মসজিদ নামে পরিচিত।
সম্প্রতি বাখরপুর জামে মসজিদ এলাকা ঘুরে ও মসজিদ পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও মুসল্লিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এই মসজিদ সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য।
জেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার ভেতরে এই মসজিদের অবস্থান। সদরের দক্ষিণে সদর-হাইমচর সড়ক হয়ে চান্দ্রা বাজার চৌরাস্তা থেকে দক্ষিণে বাখরপুর গ্রাম। মূল সড়ক থেকে গ্রামীণ সড়ক দিয়ে চান্দ্রা ইউনিয়নের বাখরপুর পশ্চিম পাড়ায় মেঘনার নদীর কাছেই মসজিদটির অবস্থান।
স্থানীয়রা জানান, এই মসজিদ কবে নির্মাণ হয়েছে তার সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ইতিহাস পর্যালোচনা ও প্রবীণ লোকদের মতে মুগল আমলেই এই মসজিদ নির্মাণ হয়েছে। এটির নির্মাণ শৈলী দেখে তাই মনে হয়।
মসজিদের উন্নয়নমূলক কাজে জড়িত নাজির পাটোয়ারী (৬৫) নামের এক মুসল্লি বলেন, মসজিদ কমপ্লেক্সটি ২৮ শতাংশ জমির ওপর। এর মধ্যে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ ভবনটি ৬ শতাংশ জমির ওপর নির্মিত। এরপর প্রায় ৩০ বছর আগে মসজিদের মুসল্লি সংকুলান না হওয়ার কারণে মসজিদ সংলগ্ন পূর্ব দিকে ৮ শতাংশের মধ্যে ৫ তলা ভিতের ওপর একতলা ভবনের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। পাশে ঈদগা ও পুকুর মিলিয়ে রয়েছে ১৪ শতাংশ।
মুগল আমলের নকশায় এই মসজিদটি তিন গম্বুজ ও ৩ তারা বিশিষ্ট। আর এই নির্মাণ কাজ হয় শুধুমাত্র চুন-সুরকরি দিয়ে। পুরো মসজিদের চারপাশে ২৮টি চুন-সুরকির তৈরি খুঁটি রয়েছে। আর এই খুঁটির সঙ্গে দেয়ালের পুরুত্ব সোয়া ৩ফুট। পাঁচটি দরজা ও মূল মিম্বারের দুই পাশে দুটি মেহরাব। সোয়া ৩ফুট পুরুত্বের জুল বিম দুটি। মসজিদটি যখন নির্মাণ হয়, তখনকার নির্মাণ শৈলী অনেকাংশ এখন আর নেই। শুধুমাত্র তিনটি গম্বুজের ভেতরের অংশে কিছু হাতে তৈরি নকশা রয়েছে বিভিন্ন রঙের।
স্থানীয়রা জানান, এই মসজিদের মূল অংশে একসঙ্গে প্রায় দেড় শতাধিক মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারে। বর্তমানে বর্ধিতাংশসহ প্রতি শুক্রবার প্রায় ৩০০ মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন।
আরও পড়ুন:
মসজিদের মুসল্লি নাজির পাটোয়ারী বলেন, আগে এই মসজিদের ওপরে বিভিন্ন ধরনের গাছ ও আবর্জনা ছিল। অনেকের কাছেই এটি জিনের কিংবা গায়েবি মসজিদ নামে পরিচিত। যে কারণে একসময় ভয়ে লোকজন মসজিদের কাছে খুব কম আসত। এই এলাকাটি মেঘনা উপকূলীয় এলাকা। নদী ভাঙনে অনেক পরিবার নিজ বসতি ছেড়ে অন্যস্থানে বসতি গড়েছেন। প্রায় ৩০-৩৫ বছর আগ থেকেই এটি সংস্কারে এলাকার লোকজন এগিয়ে আসে।
মসজিদ পরিচালনা পর্ষদের সহ-সভাপতি হাফেজ আহমেদ পাটোয়ারী বলেন, এই মসজিদ নির্মাণের প্রকৃত সময় কেউ বলতে পারে না। তবে আমরা ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানতে পারি মুগল সাম্রাজ্যের আমলে বণিকরা এই দেশে ব্যবসা করতে আসে, তখনই তারা এই মসজিদ নির্মাণ করেন। এই মসজিদের অনেক ঐতিহ্য ও সুনাম রয়েছে। অনেক দূর দূরান্ত থেকে লোকজন মসজিদটি দেখার জন্য আসে। অনেক আবার নিয়ত ও মানত করেন।
মসজিদ পরিচালনা পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক মো. ইউসুফ গাজী বলেন, অনেকেই এই মসজিদকে গায়েবি কিংবা জিনের মসজিদ বলেন। আসলে তা নয়, আমাদের পূর্ব পুরুষদের সঙ্গে কথা বলেও নির্মাণ সাল জানা যায়নি। তবে অনেকের মতে এটি মুগল আমলেই তৈরি। তখন তারা মসজিদের উত্তর ও পূর্বে পুকুর খনন করে ওই মাটির ওপর মসজিদ নির্মাণ করে। চুন ও সুরকি ব্যবহারে পুরো মসজিদ নির্মাণ হয়। এতে কোনো রড ও সিমেন্ট ব্যবহার হয়নি। তবে প্রায় ৩০-৩৫ বছর আগে চুন ও সুরকি দেয়াল থেকে পানি চুয়ে চুয়ে পড়ার কারণে এটি উন্নয়ন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেই আলোকে মূল স্থাপনা ঠিক রেখে ওপরে টাইলস বসানো হয়।
তিনি আরও বলেন, এই মসজিদ কমিটির সভাপতি মওদুদ আহমেদ দুদু খানসহ আমরা এরই মধ্যে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ সম্পন্ন করেছি। এতে স্থানীয় মুসল্লিদের দান অনুদানের পাশাপাশি সরকারিভাবে পুকুর ঘাট ও ঈদগা নির্মাণের জন্য স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ থেকে প্রায় ৯ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছি।
দুই মাস আগে এই মসজিদের ইমাম ও খতিব হিসেবে যোগ দিয়েছেন পার্শ্ববর্তী দক্ষিণ বালিয়া গ্রামের বাসিন্দা মাওলানা শফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, এই মসজিদ স্থানীয়দের কাছে বেশ পরিচিত। অনেক লোক দুর থেকে এই মসজিদ দেখার জন্য আসেন এবং এখানে এসে নামাজ পড়েন। সাধারণ মানুষ এই মসজিদকে উসিলা করে নিয়ত-মানত করেন। ওইসব লোকজনের মধ্যে কেউ কেউ বলেছেন তাদের উপকার হয়েছে। এই মসজিদের খেদমত করতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত এবং আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি।
চাঁদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাখাওয়াত জামিল সৈকত বলেন, বাখরপুর এই ধরণে একটি পুরনো ঐতিহ্যবাহী মসজিদ আছে জেনেছি এবং মসজিদটি দেখতে খুবই সুন্দর। এই মসজিদ আরও কিভাবে উন্নয়ন করা যায় সেটি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে এবং মসজিদ যাতায়াতের রাস্তাটি সংস্কারের জন্য দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এই বিষয়ে আমি ওই ইউনিয়নের প্রশাসককে জানাবো।
এমএসআই/জেএস/এমএস